ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

লন্ডন

স্টুটগার্টের চিঠি

'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে'

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১০ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৮
'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে' সঙ্গীত পরিবেশন করছেন শিল্পী কণা ইসলাম। ছবি: বাংলানিউজ

স্টুটগার্ট (জার্মানি) থেকে: আমার প্রাণপ্রিয় পরলোকগত আম্মি খুব সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন। আমার বয়স যখন ৫/৬ হবে তখন আমার আম্মি, আমার বাবার অনিচ্ছা সত্বেও আমার ও আমার বড় বোনের হাতে হারমোনিয়াম তুলে দিয়েছিলেন এবং বাড়িতে গানের শিক্ষক ঠিক রেখেছিলেন। স্বর্গীয় মায়ের স্মৃতিতে এখনও সঙ্গীতকে ধরে রেখেছি।

যদিও শৈশবের সেই চর্চা আমার বড় বোন আর ধরে রাখতে পারেননি, তবে আমি এমন গানপাগল ছিলাম যে, কোনোদিন আমার গানের শিক্ষকের আসতে দেরি হলেই কান্না জুড়ে দিতাম, সেকথা মনে আছে।  

এখনও মনে আছে, ১০ বছর বয়সে আমি রাজবাড়ী শিল্পকলা একাডেমিতে পল্লীগীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিলাম।

তারপর ফরিদপুরের স্কুল-কলেজে এবং পাড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে যখন খুব প্রশংসা পেতাম, তা দেখে আমার বাবাও আমার গানের ব্যাপারে আর কোনও অমত করেননি।  

একটি ঘটনা আমার এখনও মনে পড়ে। তখন আমরা বাবা-মায়ের সাথে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দিতে থাকি। আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখন। স্কুলের অনুষ্ঠানে আমি ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ গানটি গাইছিলাম। আমার স্কুলের ইসলাম ধর্মের শিক্ষক হাজি ছিলেন এবং সাধারণত গানের অনুষ্ঠানে আসতেন না , শিক্ষক-রুমে বসে থাকতেন। তিনি তার রুম থেকে ঐ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি শুনে কেঁদেছিলেন। তারপর প্রায়ই বাসায় আসতেন এবং বলতেন, 'তুই আমাকে সেই গানটা শোনা। ' 

আমার গানের কারণে সেই মৌলভী স্যারের আচরণে আমার বাবা যেমন মুগ্ধ হতেন, তেমনি অবাকও হতেন। সেই থেকে একটু একটু করে অবসরে গানকে আমার জীবনসঙ্গী করে ফেললাম। বড় বোন ছেড়ে দিলেও প্রচণ্ড ভালোবাসার কারণে গানকে আমি ছাড়তে পারিনি।  

স্কুলে,কলেজে এবং বাড়ির পাশের বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান-উৎসবে আমি কি কি গান গাইতাম, আমার ছেলেবেলার কাছের বন্ধুরা সেই গানগুলোর কথা এখনও মনে রেখেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি প্রফেশনাল চিন্তা-ভাবনা করে গান কখনও গাই না। বর্তমান প্রবাস জীবনে গানের মাধ্যমে আমার বাংলা সংস্কৃতিকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারছি, চর্চা করে যাচ্ছি এটাই আমার তৃপ্তি।  

আমার বর্তমান সময়ের সম্মানিত ভক্ত শ্রোতাদের অনেকে আমার গান ভালোবেসে প্রফেশনালের চেয়েও বড় প্রফেশনাল করেছেন আমাকে। এই ভালোবাসার মতো মূল্যবান আর কোনও প্রাপ্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। আমার গান-ভক্ত শ্রোতাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কিন্তু কিছু কিছু ভক্ত শ্রোতা আমাকে মাঝেমাঝে কিছু অফার দিয়ে থাকেন। যেমন, আমার নামে ফ্যান ক্লাব খুলতে চান, আমার বিভিন্ন গান এবং ছবি দিয়ে অনেক কিছু করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকেন। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মিনতি করে তাদের উদ্দেশে বলি যে, আপনারা মনে কষ্ট নেবেন না। এই ধরনের অনুমতি আমি কখনও কাউকে কোনোদিন দিইনি এবং দেবো না। কারণ আমি যেমন আছি তেমন থাকতেই পছন্দ করি। এর চেয়ে অতিরিক্ত আশা আমি কখনও করি না।  

বরং আমি চাই প্রবাসে সংস্কৃতিচর্চায় এবং দেশের অভাবী অসহায় মানুষের পাশে প্রবাসী ভাইবোনেরা এসে দাঁড়ান। দেশকে কখনোই যেন ভুলে না যান। মানুষ তো আসলে মানুষের জন্যই। মানুষের জন্য কাজ করতে পারলেই মানবজীবন ধন্য ও সার্থক হবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি আর কি চাইবো? মানুষের সুখ আর কল্যাণ দেখতে পেলেই আমি তৃপ্তি পাই। একজন সঙ্গীত সাধনাকারী হিসাবে শুধু এইটুকুই আমার চাওয়া।  আমি যখন থাকবো না এই নশ্বর পৃথিবীতে, 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে', তখন মানুষ যদি আমার কথা মনে রাখে, তবেই ধন্য হবে একজন শিল্পী হিসাবে আমার মানবজনম।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৮

জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।