ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

ভুল চিকিৎসায় রাইফার মৃত্যু ও বিচার দাবির প্রসঙ্গে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৯ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১৮
ভুল চিকিৎসায় রাইফার মৃত্যু ও বিচার দাবির প্রসঙ্গে ম্যাক্স হাসপাতাল ভবন ও শিশু রাইফা

চট্টগ্রামের ম্যাক্স হসপিটালে ভুল চিকিৎসায় রাইফা নামের এক শিশুর মৃত্যু নিয়ে সাংবাদিক ও চিকিৎসকরা পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। দুটি পেশাজীবী গোষ্ঠীর একে অন্যের বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক নয়। এতে বেশি ক্ষতি হচ্ছে চিকিৎসকদের, তাদের ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতি আরও বাড়ছে।

ম্যাক্স হাসপাতালে রাইফার ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর পর থেকে প্রশ্ন উঠছে, চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অতীতের যেসব ভয়ঙ্কর অনিয়ম ও অবহেলা তা এতদিন পত্র-পত্রিকায় আসেনি কেন? রাইফার মৃত্যুর বিষয়টা আদালতের কাছে সোপর্দ করা নিয়েও কথা হচ্ছে। বিষয়টা আদালতে গেলে এক পক্ষ অন্য পক্ষের প্রতি বিষোদগারের সুযোগ থাকবে না।

‘এবারও যদি আপনারা হারেন- তাহলে দীর্ঘ হবে রাইফাদের লাশের সারি। ’ রাইফার মৃত্যুর কয়েকদিন পর ফেসবুকে এমন একটি পোস্ট দেখা গেছে। এরকম আরও অনেক পোস্টই ঘুরছে মুহূর্তে মুহূর্তে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আপডেট খবর দিচ্ছে। ডা. খুরশিদ জামিল তো বলেই দিলেন- সাংবাদিকদের মাইর দেওয়ার জন্য। এটা নিয়েও তোলপাড়। তোলপাড় হবারই কথা। একজন ভদ্রলোকে কথা এমন হতে পারে না। এটা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো পন্থাও নয়। সবকিছু মিলে উস্কানির মাত্রাটা বেড়েই যাচ্ছে।

চিকিৎসকদের উচিত তাদের পেশার জায়গাটাকে এই পর্যায়ে পরিচ্ছন্ন করা।  এরকম ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে শুধু সাংবাদিকদের স্বজন-পরিজন নয়, চিকিৎসকদের স্বজন পরিজনরাও মৃত্যুর শিকার হতে পারে। এই কথাটা সবার ভাবতে হবে।

লেজেগোবরে চিকিৎসা ব্যবস্থার যে কাঠামো দাঁড় করা হয়েছে চট্টগ্রামে সেটাকে যতটুকু সম্ভব পূর্ণতা দেয়া, জবাবদিহিতার জায়গায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। কোনো পেশাজীবীর এক পক্ষ অন্য পক্ষকে এভাবে কথা বলা ভদ্রসমাজে শোভা পায় না। সবকিছু মিলে উস্কানির মাত্রাটা বাড়ছেই। সমাধানের কোনো পরামর্শ নেই। সমাধান মানে সমঝোতা নয়, বিচার। ভুল চিকিৎসায় রাইফা হত্যার বিচার। কিন্তু বিচারের কথা আমরা বলতে পারি না। চিকিৎসকরা কেন বিচারের জায়গায় যেতে সহযোগিতা করছেন না। তারা কেন সবাই মিলে একটা অব্যবস্থাপনার পক্ষে চিৎকার করছেন? এটা চিকিৎসকদের কৌশল যে, আসল ঘটনা থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়া। নতুন একটা ঘটনার মাধ্যমে আসল ঘটনা আড়াল করা।

সাংবাদিকদের উচিত দ্রুত বিচারের জায়গায় কড়া নাড়া। যতই রাস্তায় ক্ষোভ বিক্ষোভ ঝাড়া হবে ততই বিচার দূরে সরে যাবে। এজন্য মামলা করে মামলাটা চালিয়ে নিলে হয়। প্রয়োজনে হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, চট্টগ্রামের সমগ্র চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া যায়। কিন্তু কেন বিচারের জায়গায় যেতে সঙ্কট? নাকি সমঝোতার পথ খোঁজা হচ্ছে! এরকম আরও সঙ্কটে আমরা বিচারের জায়গায় যেতে পারিনি কেন? এর অনেক উদাহরণ আছে। তাই এই কথাটা আসছে, যেন এতকিছুর ফলাফলটা পূর্ব নির্ধারিত।

ক্ষমতার কারণে আমরা হয়তো ভাবি- আমার ছেলেমেয়ে বা স্বজন-পরিজনের কোনো সমস্যা বা ভুল চিকিৎসা হবে না। কিন্তু যারা সারাজীবন অবহেলা আর গতানুগতিকতার মধ্যে নিজেদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে এসেছেন তারা ক্ষমতাবানের ছেলেমেয়ে বা পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে সিরিয়াস হলেও সাধারণ রোগী তাদের অবহেলা থেকে রক্ষা পাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কারণ তাদের প্র্যাকটিস হলো- অবহেলা।

চিকিৎসকরা শিক্ষার্থী হিসেবে মেধাবী ছিলেন । তাদের মেধার কারণে ভেতরে কোনো মানবতাবোধের ঠাঁই হয়নি! আর দেশপ্রেমের কথা নাই বললাম। একজন বস্তির হাতুড়ে ডাক্তারও বিনা পয়সায় প্রেসক্রিপশন দিয়ে রোগী দেখেন। অথচ যাদের সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে বড় ডাক্তার বানিয়েছে তাদের বেশিরভাগ হন মানবতাবিবর্জিত। প্রায়শ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কোনো কোনো চিকিৎসকের নামে যে ভয়ঙ্কর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তাতে ভালো চিকিৎসকদের প্রতিও অবিশ্বাস ও আস্থার সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

আমাদের প্রফেশনাল দায়টা কেমন হতে পারে। আমরা কতটা তা পালন করি। ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করলে আমি যদি মনে করতাম আমার রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে, তাহলে আমি সরাসরি আইন আদালতের কাছে অভিযোগ করব। তথ্য-প্রমাণের মারফতে বিচার যার পক্ষে যাবে, যাক। এটাতে আমাদের বিশ্বাস নেই কেন? কারণ, এটা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। এমনকি নামকাওয়াস্তেও না। কত কত রোগীর স্বজন ভুল চিকিৎসায় তাদের আত্মীয় স্বজনকে হারিয়ে ডাক্তারকে অভিসম্পাত দিচ্ছেন, অথচ বিচারের আশা করছেন না!

চিকিৎসাশাস্ত্র এমন একটা ক্ষেত্র যেখানে শিক্ষিত মানুষও অজ্ঞ। তাহলে মানুষের সন্দেহ ও অসহায়ত্তের সুরাহা কীভাবে সম্ভব? এর একটা উপায়- চিকিৎসকদের দায়িত্বশীল হওয়া। আমাদের সরকার শত চেষ্টা করেও গরিব মানুষের জন্য চিকিৎসকদের গ্রামে পাঠাতে পারেনি। পৃথিবীতে বহু দেশে মানুষের চিকিৎসার দায়িত্ব পুরোপুরি রাষ্ট্রের কাঁধে। এটা হলে ডাক্তাররা আর প্রাইভেট চিকিৎসার নামে দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে পারত না। হাসপাতালও রোগ পরীক্ষার নামে এত এত টাকা লোপাট করার সুযোগ পেত না।

সব চিকিৎসকদের ব্যাপারে ঢালাও বলা যায় না। কিন্তু এখানে স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার সিস্টেমটা গড়ে ওঠেনি। আমরা কি জানি তাদের আসল কাঠামোটার কথা? আমারা চাইলে প্রত্যেক হাসপাতালের খবর নিতে পারি। কিন্তু কেন নিচ্ছি না। কারণ আছে। কারণ আছে বলেই সমঝোতার সন্দেহের কথা বলছি। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার তথ্য দেওয়া সংবাদ মাধ্যমগুলোর কাজ।  কিন্তু সময়মত অসঙ্গতি, অন্যায় ও অবহেলার বিষয়ে কেন খবর আসে না?

জনগণকে জানানোর বদলে আমরা এই ধরনের সিস্টেমকে লালন-পালন করেছি। এখানে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকতা গড়ে উঠেছে সেটার বাইরে চিন্তা-ভাবনা করিনি। আমরা মনে করেছি- এই সিস্টেম থেকে আমার চাওয়া-পাওয়া আদায় করে নিতে পারব। সাধারণ মানুষের বাদ দিয়ে দিয়েছি। আমরা বেশিরভাগ নিজের জন্যই প্রতিষ্ঠান ও পেশায় যুক্ত হই। আমরা মনে করি কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠান আমার জানমাল ও সম্ভ্রমের রক্ষাকবচ। কিন্তু যার কোনো ক্ষমতা নেই তারা কিভাবে এই সিস্টেমের কাছে জিম্মি হচ্ছে, সেই তাড়না আমরা অনুভব করি না।

চট্টগ্রাম শহরে চিকিৎসাসেবা একটা বিশাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এটা এমন ব্যবসা যে শিল্পপতিদের জন্যও লোভনীয়। বড় বড় শিল্পপতিরা মেডিকেল ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন। কারণ প্রচুর মুনাফা। একটা মেডিকেল টেস্ট ৬/৭ জন দালালের হাত ঘুরে আসার পরও প্রকৃতই যারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন তারাও প্রচুর মুনাফা পাচ্ছেন। ৬/৭ জন দালাল ঘুরে আসার পরও এত লাভ কীভাবে হচ্ছে! মানে একজন রোগীর কাছ থেকে কয়েকজন রোগীর পয়সা কামাই হচ্ছে!
 
প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হলে সেটার বিরুদ্ধে অভিযোগের বন্দোবস্ত থাকতে হয়। সিস্টেম মানতে হয়। অভিযোগ ও বিচারের পথটাও জানিয়ে রাখতে হয়। চট্টগ্রামে মেডিকেল ব্যবসার কোনো সিস্টেম গড়ে উঠেনি কেন? খোদ সরকারও এই চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে পেরে উঠে না। এই অব্যবস্থাপনাই টাকা কামানোর এখন হাতিয়ার।

সাংবাদিক জন সমাজের চরিত্র বদলের জন্য কাজ করে না। কিন্তু তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে সমাজচরিত্র নির্ধারণ হয়। আজ রাইফার মৃত্যুর পর ম্যাক্স হাসপাতালের মত বড় একটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে এত এত অভিযোগ। কিন্তু এটি গড়ে ওঠার সময় সংবাদমাধ্যম কোথায় ছিল?

এখন বলা হচ্ছে ম্যাক্স হাসপাতাল শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে হসপিটাল ব্যবসা শুরু করেছে। তাদের কাছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স নেই। কেন অন্য হাসপাতালগুলোর কথাও বলছে না। এই বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই চিকিৎসকরা সবাই মিলে সাংবাদিকদের ‘মাইর’ দেয়ার জন্য বলছে। কারণ তারা এ রকম অনিয়মের মধ্যেই হাসপাতালগুলো চালিয়ে নিচ্ছে এবং নিতে চায়।  

যেখানে ম্যাক্স হাসপাতালের মত বড় একটি হাসপাতালে লাইসেন্সের সমস্যা আছে, কর্তব্যরত নার্স ও ডাক্তারদের নিয়োগপত্র নেই, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই, কোনো মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নেই, কোনো রিপোর্ট নিরীক্ষাকারী ডাক্তার নেই সেখানে অন্য প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনোসিসগুলোর কী অবস্থা! এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও দায়ী। এত অনিয়মের খবর শুনে নিশ্চয়ই মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকবে।  

জনসেবার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা না হলে, ব্যক্তিবিশেষ যতই উপরতলার লোক হোক না কেন, জনসেবার সেবাটা নিজের জন্যও জুটবে না। কারণ সিস্টেম যেখানে গড়ে ওঠেনি সেখানে আমি যতই হাঁকডাক করি না কেন, লাভ হবে না। সব সময় ‘আমরা আমরাই’ পেতে চাইছি। অন্যের জন্য নয়। যেখানে আমাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে অব্যবস্থাপনাগুলো আড়াল করা হয়েছে। সেটা সময়ে সময়ে নিজের আপনজনের প্রাণের মূল্যে শোধ করতে হয়। তখন সহায়তাকারী যাদের মনে হয়েছে তারা শত্রুতে পরিণত হয়। স্পেশাল টেককেয়ার তো দূরের কথা। পেশাজীবী গোষ্ঠী যখন তাদের দায়িত্ব  বোঝে না সেখানে কখনো সিস্টেম গড়ে ওঠে না। সেটা চিকিৎসক কিংবা গণমাধ্যম যার দায়িত্বই হোক।  

সুরেশ কুমার দাশ: অতিথি প্রযোজক (বার্তা), বাংলাদেশ টেলিভিশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৮
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।