ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বাংলার প্রাণের কাছে

বাংলার প্রাণের কাছে

বাহে শোন মোর ভাওয়াইয়া গান

মাহবুব আলম, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১৬
বাহে শোন মোর ভাওয়াইয়া গান ছবি: নূর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুড়িগ্রাম থেকে: ‘রংপুরিয়া ভাওয়াইয়া গান, আউলাইলে অভাগীর পরান/মন মজাইলে করিলে উদাসী কি হায়রে হায়…’ গীতিকার রবীন্দ্রনাথ মিশ্রের আঞ্চলিক ভাষার এই গানের মতো অসংখ্য সুর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেশের উত্তর জনপদে।

সুপ্রাচীন এ জনপদের নিজস্ব সৃষ্টিশীল ধারা ভাওয়াইয়া।

এক সময় বাড়িতে-বাড়িতে দেশীয় বাজনা নিয়ে পল্লীগানের আসর বসলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে এর কদর হারাচ্ছে!

তবে গাঁও-গেরামের মাটির সন্তানরা এখনও নিজের লোকজ সংস্কৃতির শেকড় আঁকড়ে আছেন।
 
গবেষকরা বলছেন, ভাবের যে গান সেটাই ভাওয়াইয়া। উত্তরাঞ্চল ছাড়াও ভারতের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও আসাম এ গানের আদিস্থান। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এ লোকগানের উপজীব্য বিষয় নদী, নারী ও প্রকৃতি।

তবে বাউদিয়া নামে ‘উদাসী’ সম্প্রদায় এ গানের রূপকার বলে কেউ কেউ ধারণা করেন। এই বাউদিয়া থেকেই ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি। যা দেশে-বিদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছেন আব্বাস উদ্দিন আহমদ।

প্রায় বেশিরভাগ ভাওয়াইয়া গানে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্রের কথা উঠে এসেছে। বলা হয়েছে স্থানীয়দের পেশা-জীবিকা ও পতির জন্যে নারী মনের আকুতিও।

নিজস্ব ঢং আর রীতিতে পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে দুই ধরনের এ ঐতিহ্যবাহী গান।

ভাওয়াইয়া গবেষক ভূপতি ভূষণ বর্মা বাংলানিউজকে বলেন, ভাওয়াইয়ার একটা অংশ চটকা সুরের, অন্যটা দীর্ঘ সুরের।
‘চটকা সাধারণত এক প্রকার রঙ্গগীতি। এ গান চটুল ও দ্রুত তালের। গ্রাম্য ‘চট’ (অর্থ তাড়াতাড়ি) শব্দটির স্ত্রী লিঙ্গান্তর করে ‘চটকা’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। এ শ্রেণির গানে যথেষ্ট হাস্যরসের উপাদান থাকে। ’
 

‘ওরে পতিধন বাড়ি ছাড়িয়া না যান’, ‘পানিয়া মরা মোক মারিলু রে’, ‘আবো নওদারিটা মরিয়া মোর সে হইছে হানি, ‘ওরে কাইনের ম্যায়ার ঠসক বেশি/ ব্যাড়ায় শালী টাড়ি টাড়ি’ চটকা গান।
 
দীর্ঘ সুরের ভাওইয়ায় অনুরাগ, প্রেমপ্রীতি ও ভালোবাসার কথা ব্যক্ত হয়।   ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘কোন দ্যাশে যান মইশাল বন্দুরে’, ‘নউতোন পিরিতির বড় জ্বালা’ অধিক সমাদৃত।

আরেকটা ধারা ব্যানা কুশানের গান হিসেবে গায় অনেকে। রামলীলা অর্থাৎ জীবনীভিত্তিক গানকে পালার মাধ্যমে গাওয়া হয়। এ জন্যে আলাদা গানের দল থাকে। ছেলেরা মেয়ে সেজে এ পালা পরিবেশন করেন।
 
এদিকে, বর্তমানে ভাওয়াইয়া গানের প্রধান বাদ্য দোতরা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের গীতিকার-সুরকার পঞ্চানন রায় বাংলানিউজকে বলেন, দোতরা পাওয়াই যায় না। কোথাও সারিন্দা এক দুইটা জুরির দেখা মেলে। তাছাড়া কারিগরও পাওয়া যায় না।
 
তিনি জানান, নিয়মিত বৈঠকী আসর না বসলেও রংপুর বেতার ও স্থানীয় রেডিও চিলমারীতে নির্ধারিত দিনে ভাওয়াইয়া প্রচার হয়। মানুষও শোনেন, কিন্তু সেসব গানে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রী খুব একটা থাকে না।

‘নিজস্ব এ সম্পদকে রক্ষায় কারও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই’ বলেই মনে করেন বেতার রংপুর কেন্দ্রের শিল্পী ভবতরণ চন্দ্র বর্মা।

‘আমরা চাই এই ডিশ লাইন-স্মার্টফোনের যুগেও যেনো তারা একান্তই নিজের সংস্কৃতি চর্চা করে। কারণ তারাই তো আগামী দিনে ভাওয়াইয়াকে বাঁচিয়ে রাখবে। ’-এমনটাই চাওয়া এ শিল্পীর।

স্থানীয় ভাওয়াইয়া সমঝদার অনেকেই জানান, আব্বাস উদ্দিন ছাড়াও কছিম উদ্দিন, নুরুল ইসলাম জাহিদ, রবীন্দ্রনাথ মিশ্রের অসংখ্য ভাওয়াইয়া গান রয়েছে। নতুন নতুন গীতিকারও সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে গান লিখছেন এখন।

তবে সমৃদ্ধ লোকজ সংস্কৃতির অংশ ভাওয়াইয়াকে সংরক্ষণ করতে সরকারসহ সমাজের উচ্চবিত্তদের পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানান ভাওয়াইয়া শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মা।

তার মতে, গানগুলো সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রচার, গবেষণার জন্যে রংপুরে আব্বাস উদ্দিন আহমদ একাডেমি নির্মাণ করা যেতে পারে।   যেমনটা হয়েছে পাশের দেশ ভারতে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৬
এমএ/এসআর

** ‘আয়সাই আব্বাস গাইলেন হাঁকাও গাড়ি চিলমারী’
** আহা! সেকি সুর শিরিষের সারিন্দায়! (ভিডিও)
** হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর এ রে...
** বাংলার প্রাণের কাছে বাংলানিউজ, সঙ্গী হোন আপনিও
** শেকড়ের সন্ধানে উত্তর জনপদে বাংলানিউজের মাহবুব ও নূর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।