ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শেয়ারবাজার

আইপিও’র অর্থ ব্যবহারে ব্যর্থ ‘অর্ধেক’ কোম্পানি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
আইপিও’র অর্থ ব্যবহারে ব্যর্থ ‘অর্ধেক’ কোম্পানি

ঢাকা: প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ যথাযথ ব্যবহারে ব্যর্থ হয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত পাঁচটি কোম্পানি। শুধু তাই নয়, বাজার থেকে তুলে নেওয়া অর্থ ব্যাংকে আমানত রেখে নিয়মিত সুদও নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। ফলে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশার ছিটেফোঁটাও পূরণ হয়নি। কোনো লভ্যাংশ পর্যন্ত পাননি বিনিয়োগকারীরা। উল্টো শেয়ারের দাম কমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে- আমান ফিড, রিজেন্ট টেক্সটাইলস, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, শাশা ডেনিমস এবং ইয়াকিন পলিমার লিমিটেড তাদের প্রতিশ্রুতি রাখেনি। ২০১৭ সালের মধ্যে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ, কোম্পানি সম্প্রসারণ এবং আইপিওতে ব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো এ পাঁচটি কোম্পানিসহ মোট ১০টি কোম্পানি।

 

বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কোম্পানি কর্তৃপক্ষের অযোগ্যতা, অদক্ষতার এবং অদূরদর্শিতার পাশাপাশি সদিচ্ছা না থাকায় ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিগুলো।

প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের মূলত প্রলুব্ধ করেছিলো। বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন যে, কোম্পানিগুলো আইপিওর এই টাকা কাজে লাগিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে। এতে কোম্পানির উৎপাদন বাড়বে, মুনাফা বাড়বে, শেয়ার হোল্ডাররা লভ্যাংশ পাবেন। এর পাশাপাশি শেয়ারের দামও বাড়বে। বাস্তবে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। শেয়ার হোল্ডাররা, বঞ্চিত-প্রতারিত হয়েছে। শেয়ার কিনেও শেয়ারের লব্যাংশ পাননি। পাননি আর সব প্রাপ্য সুবিধা। ফাঁকতালে কোম্পানিগুলো শেয়ার হোল্ডারদের ঠকিয়ে নিজেরাই অন্যায়ভাবে লাভবান হয়েছে।

বাজার-সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য:
কোম্পানিগুলোর অযোগ্যতা, অদক্ষতা এবং অদূরদর্শীতার পাশাপাশি সদিচ্ছা না থাকায় প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা ভঙ্গ করেছে।  বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এহেন আচরণ প্রতারণার সামিল। এমনটাই  মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উচিৎ এই অনিয়মের বিষয়টিকে বিনিয়োগকারী সুরক্ষা আইনের আওতায় আনা এবং কোম্পানিটিকে শাস্তি দেওয়া। ভবিষ্যতে যেন তারা বা অন্য কোনো কোম্পানি এমন কাজ করতে না পারে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতার কারণেই এসব কোম্পানির এমন নাজুক দশা। তিনি বলেন, কোম্পানির ভবিষৎ নির্ভর করে কোম্পানির সুদক্ষ পরিচালনার ওপর। কিন্তু সেটা করতে তারা অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে অর্থ ব্যবহার না করলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চলতি বছরের মধ্যে (অর্থাৎ ২০১৭ সাল) আইপিওর টাকা টাকা ব্যয় করবে বলে ১২টি কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) এবং রাইট শেয়ারের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করে। এই কোম্পানিগুলো ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে আইপিও এবং রাইট শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে এক হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছে। শুরুতে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে এই টাকা নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ করা হবে।

প্রতিশ্রুতি অনুসারে মাত্র ৫টি কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে আইপিওর টাকা ব্যয় করেছে। এগুলো হচ্ছে, বিএসআরএম লিমিটেড, মতিন স্পিনিং মিলস, ইভেন্সি টেক্সটাইলস, তসরিফা ইন্ডাস্টিজ এবং ইউনাইটেড পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। এ ছাড়াও রাইট শেয়ারের টাকা ব্যয় করেছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড।

কিন্তু আমান ফিড, রিজেন্ট টেক্সটাইলস, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, শাশা ডেনিমস এবং ইয়াকিন পলিমার লিমিটেড এই ৫ কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে আইপিও’র ১৭ থেকে ৯৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেনি। এছাড়াও রাইট শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে বিপুল টাকা তুলে নিয়ে ব্যয় করেনি বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড। এই ছয় কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৫০৪ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। অথচ এখনো ব্যয় করেনি ১৯৯ কোটি টাকা। বরং আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে একের পর এক সময় বৃদ্ধি করছে।

আইপিও ও রাইট শেয়ারের টাকা তুলে তা পরিশোধ করেনি যেসব কোম্পানি

সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ: প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালে আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৬০ কোটি টাকা তুলে নেয়। কথা ছিলো, চলতি বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আইপিও’র সব অর্থ উপযুক্ত খাতে ব্যয় করবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ১৭ কোটি ৭ লাখ ২হাজার ৭৯৪ টাকা ব্যয় করেনি। যা শতাংশের হিসাবে মোট অর্থের ২৮ শতাংশ।

এই টাকা এখন ব্যাংকে আমানত রেখে সুদ নিচ্ছে কোম্পানিটি। শুধু তাই নয়, নিজেদের দোষ ঢাকতে কৌশলে কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) নতুন করে সময় বাড়িয়ে নিয়েছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। একই অবস্থা বাকি ৫টি কোম্পানিরও।

শাশা ডেনিমস: ১৭৫ কোটি টাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে বস্ত্রখাতে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। কথা ছিলো ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আইপিও’র সব অর্থ ব্যয় করবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের ২৯ কোটি ৬৭ লাখ ৬ হাজার ১০৯ টাকা ব্যয় করেনি। যা শতাংশের হিসাবে ১৭ শতাংশ। বরং বিনিয়োগকারীদের টাকা ব্যাংকে রেখে সুদনিচ্ছে।

আমান ফিড লিমিটেড: ব্যবসা সম্প্রসারণ ও আইপিও’র খরচ বাবদ ব্যয়সহ বিভিন্ন খাত দেখিয়ে ২০১৫ সালে পুঁজিবাজার থেকে ৭২ কোটি টাকা উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটি। কথা ছিলো, চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এই টাকা ব্যয় করবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরও ১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেনি কোম্পানিটি। যা শতাংশের হিসাবে তা ৪৭ শতাংশ।

ইয়াকিন পলিমার: তিনটি খাতে ব্যয়ের জন্য ২০১৬ সালে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটি। কথা ছিলো, চলতি বছরের৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেই টাকা ব্যয় করবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগকারীদের ৪ কোটি ৪৩লাখ ৮৯ হাজার ১৮০ টাকা ব্যয় করেনি। যা শতাংশের হিসাবে মোট টাকার ২২ দশমিক ১৯ শতাংশ।

রিজেন্ট টেক্সটাইলস: আধুনিকায়ন ও ব্যবসা সম্প্রসারণের পাশাপাশি একটি কারখানা তৈরি করবে বলে পুঁজিবাজার থেকে ২০১৫ সালে ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে তারা । কথা ছিলো ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে আইপিওর সব টাকা বিনিয়োগ করবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে মাত্র ৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। যা শতাংশের হিসাবে ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

বিডিথাই: রাইট শেয়ারের মাধ্যমে নয় খাতে ব্যয় করতে বিডি থাই ৫২ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ২৮০ টাকা উত্তোলন করে। এর মধ্যে ৪০ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ২৪০ টাকা ব্যয় করেছি। তবে এখনো ব্যয় করেনি ১১কোটি ৯৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৪৫ টাকা। শতাংশের হিসাবে যা মোট অর্থের ২২ দশমকি ৮২ শতাংশ।

কোম্পানিগুলোর বক্তব্য:

রিজেন্ট টেক্সটাইলস: কোম্পানির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) অঞ্জন কুমার ভট্টাচার্য বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কোম্পানি আইপিওর টাকা ব্যবহার করতে পারিনি এটা ঠিক। টাকা ব্যাংকে আছে, সময়মতো ব্যবহার করা হবে। তিনি বলেন, কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) আইপিওর অর্থ ব্যবহারের সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হবে।

শাশা ডেনিমস: কোম্পানির সচিব আসলাম আহমেদ খান বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রথমে যে পরিকল্পনা নিয়ে টাকা উত্তোলন করেছি, পরে তার কিছুটা পরিবর্তন করেছি। তাই নির্ধারিত সময়ে কাজ সমাপ্ত করতে পারনি। তবে নতুন করে যে সময় নিয়েছি, সেই সময়ের মধ্যে অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে পারবো।

ইয়াকিন পলিমার: কোম্পানির সচিব আখতারুজ্জামান বাংলানিউজকে দাবি করে বলেন, ‘আইপিও’র সব টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে তা অডিটে আসেনি। ’ অর্থাৎ খাতা কলমে এখনো সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয় হয়নি। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘মেশিনারিজগুলো এখনো কোম্পানিতে এসে পৌঁছায়নি, বন্দরে রয়েছে। তাই আইপিওর টাকা অব্যবহৃত দেখিয়েছি। ’ কিন্তু আইপিও’র টাকা ঠিকই ব্যয় করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়:১৯৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
এমএফআই/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।