ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

কৃষি

ঔষধি গ্রামকে আত্মনির্ভরশীল করে গেছেন আফাজ পাগলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৭
ঔষধি গ্রামকে আত্মনির্ভরশীল করে গেছেন আফাজ পাগলা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভেষজ-ঔষধি গাছের সম্প্রসারণ ও চিকিৎসার উন্নয়নে কাজ করে গেছেন আফাজ পাগলা। ছবি: বাংলানিউজ

নাটোর: প্রায় ৩৫ বছর আগে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন নাটোর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের আফাজ উদ্দিন। কোনো চিকিৎসাপত্রেই রোগ সারছিল না। পরে নানির কাছে গাছ-গাছড়ার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন।

তখন থেকেই ঔষধি গাছের প্রতি টান তৈরি হয় আফাজের। নানির কাছে ভেষজের গুণাগুণ ও চিকিৎসা বিদ্যা শিখে নিজের প্রয়োজনেই শুরু করেন এসব গাছ রোপণ।

শুরুতে মাত্র ৫টি ঘৃতকুমারীর গাছ রোপণ করেছিলেন এই ভেষজ চিকিৎসক। পরে বাড়ির আঙিনা ও আশপাশে ছড়িয়ে দেন। পাশাপাশি শুরু করেন কবিরাজি চিকিৎসা। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসতেন তার চিকিৎসা নিতে।  

ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিনকে নিয়ে হাটে-বাজারে গান গেয়ে ওষুধ বিক্রি ও চিকিৎসা দেওয়াও শুরু করেন।

ঔষধি গাছ রোপণ আর কবিরাজি-ভেষজ চিকিৎসায় তার এ ভালোবাসায় মুগ্ধ গ্রামবাসী এক সময় ‘আফাজ পাগল’ নামে ডাকতে ও চিনতে শুরু করেন আফাজ উদ্দিনকে।

নিজে ঔষধি গাছ চাষ করেই থেমে থাকেননি, অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেছিলেন। গ্রামবাসীর আগ্রহ তৈরি হলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে নানা জাতের ঔষধি গাছের বীজ ও চারা সংগ্রহ করে বিনামূল্যে জোগান দিয়েছিলেন এই বৃক্ষপ্রেমী মানুষটি।

আফাজ উদ্দিনের গড়া চিস্তিয়া বনজ দাওয়াখানা বা আফাজ পাগলার ভেষজ চিকিৎসালয়।  ছবি: বাংলানিউজপরে জন থেকে জনে, গ্রাম থেকে গ্রামে ঔষধি গাছ রোপণের ধুম পড়ে যায়। এভাবে চাষ বাড়তে থাকা খোলাবাড়িয়া গ্রামটি ‘ঔষধি গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পায়। বর্তমানে মিছরিদানা, ভূঁইকুমড়ো, তুলসি, হরিতকি, আমলকি, বহেরা, বাসক, ঘৃতকাঞ্চন, শতমূলি, শিমুল, অশ্বগন্ধাসহ ১৪০ প্রজাতির ঔষধি গাছের চাষাবাদ করা হচ্ছে এখানে।

ভেষজের এই চাষাবাদ এখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী গ্রামগুলোতেও। উৎপাদিত গাছ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। স্থানীয়ভাবেও গড়ে উঠেছে ঔষধি বাজার ও ভেষজ সেন্টার।

ঔষধির বদৌলতে গ্রামটির নামের পাশাপাশি বদলে গেছে পুরো গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা। বদলে গেছে তাদের চিন্তা-চেতনা এবং কাজকর্ম। প্রায় ১ হাজার ৬০০ পরিবার এখন ঔষধি গাছে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

এ ভেষজ বিপ্লবের পেছনের নেপথ্য নায়ক ছিলেন আফাজ পাগল। গ্রামের মানুষকে আত্মনির্ভরশীলতার পথও দেখিয়েছেন তিনিই। উৎসাহ, বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন,  সহযোগিতাও করেছেন ভেষজের চাষাবাদে।
এখন সবাই একই পথের পথিক, গ্রামজুড়ে পাগল আর পাগল, তবে গাছপাগল।

এখন সব পাগল আছেন, কিন্তু আফাজ পাগল আর নেই। গত ০৫ নভেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ ইন্তেকাল করেছেন তিনি। প্রায় ৮৫ বছরের এই গুণী মানুষটির স্ত্রী, তিন মেয়ে ও পালিত এক ছেলেও ভেষজ চিকিৎসা ও ঔষধি সম্প্রসারণে নিবেদিতপ্রাণ।

তার গড়া চিস্তিয়া বনজ দাওয়াখানা বা আফাজ পাগলার ভেষজ চিকিৎসালয় এখন সামলাচ্ছেন আগে থেকেই কাজ করে আসা আফাজ উদ্দিনের স্ত্রী হেলেনা পাগলী।  

লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের ভেষজ বিপ্লবের পেছনের নেপথ্য নায়ক ছিলেন আফাজ পাগল।  ছবি: বাংলানিউজলক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল বাতেন ভূঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘আফাজ পাগলা কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালের ‘চ্যানেল আই কৃষি পদক’ ছাড়াও স্থানীয়ভাবে পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার। অবসরে তিনি একাকি আধ্যাত্মিক গান গাইতে বেশি পছন্দ করতেন’।

‘তার গড়ে তোলা কবিরাজি চিকিৎসালয়ে নানা রোগের চিকিৎসা নিতে আসতেন দেশের বিভিন্ন স্থানের লোকজন। ঔষধি গাছের গ্রামের ভেষজ বিপ্লবের এই মহানায়কের মৃত্যুতে পুরো এলাকাজুড়ে এখনও শোকের ছায়া বইছে’।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৭
এএসআর
**
ভেষজ বিপ্লবে গ্রামের খ্যাতি দেশজুড়ে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।