ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

উপকূল থেকে উপকূল

জালে জড়ানো জীবন! 

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৮ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৮
জালে জড়ানো জীবন!  জাল বুনছেন সেকান্দার আলী খান। ছবি: বাংলানিউজ

উপকূল ঘুরে এসে: ঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা জলদস্যু; সব কিছুই মোকাবেলা করে থাকতে হয় উপকূলের বাসিন্দাদের। আর জীবিকার জন্য জীবন বাজি রেখে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে অথৈ সাগরে যেতে হয় মাছ শিকারে। 

ভাগ্য ভালো হলে ভালো ভালো মাছ নিয়ে ঘরে ফেরা সম্ভব হয়, আর না হলে ঝড় বা দস্যুর কবলে পড়ে হতে হয় নিখোঁজ বা মৃত। এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাপ-দাদার মতো মাছ ধরাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন এখানকার জনগণ।

দিনরাত হাড়ভাঙ্গা শ্রম দিয়ে যে মাছ ধরেন তা দিয়ে কোনো মতে চলে সংসার।

বিষখালী, বলেশ্বর আর বঙ্গোপসাগর। সাগর ও নদী বেষ্টিত বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই মৎস্য শিকারি। এ অঞ্চলের মানুষ পরিবার নিয়ে তিন বেলা খেয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনটা মেটানোর জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরতে সাগরে যান। শৈশব থেকেই মাছ ধরে চলছে এখানকার জেলেদের জীবিকা, এতে কোনো মতে পরিবারের জন্য দু’মুঠো ভাতের জোগাড় হলেও ভাগ্য বদল হয় না।  

বিষখালী নদী সংলগ্ন জিনতলা গ্রাম। যে গ্রামের শতভাগ লোকই মাছ শিকার করে। এ জেলে পল্লীতে গিয়ে দেখা মেলে সেকান্দার আলী খানের। মনের আনন্দে গুণ গুণ করে গান গাইছিলেন আর ছেঁড়া জাল মেরামত করছিলেন। জাল বোনার ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ১২ বছর বয়স থেকে মাছ ধরছি। এখন আমার বয়স প্রায় ৫০। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিন বছর ধরে আর সাগরে যাই না। এখন জাল বুনেই জীবন চলছে। দিনে কাজ পেলে চার থেকে সাড়ে চারশ’ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই চলে দুই ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীসহ চারজনের সংসার। তবে সবদিন কাজ জোটে না। তখন অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে। সারা জীবন শ্রম দিয়েও আমাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। বাপ-দাদার যা জমি ছিল, তা নদীতে গেছে। জেলে পল্লীতে মায়ের জমিতে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুই এখন সম্বল।  

বিষখালী নদীর পাশেই ট্রলার মেরামত করছিলেন জিনতলা বাঁধের বাসিন্দা মিস্ত্রী আলী আহম্মদ খান। তিনিও বললেন, বাপ-দাদা জেলে ছিলেন। তাদের পেশা ছাড়তে পারছি না। কৈশোর থেকে যৌবন কাটিয়েছি সাগর-নদীতে মাছ ধরে। বয়স হয়েছে, এখন আর সাগরে যাই না।  জাল, নৌকায় আমরা জড়িয়ে আছি। তাই কূলে জেলে নৌকা আর ট্রলার মেরামত করি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে চার থেকে সাড়ে চারশ’ টাকা পাই। তাও প্রতিদিন কাজ মেলে না। যা আয় হয় তা দিয়ে এক মেয়ে, দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে চলছে। নেই জমানো টাকা বা জমি। তাই বাঁধের কাছে সরকারি জমিতেই থাকি।  
ট্রলার মেরামত করছেন মিস্ত্রী আলী আহম্মদ খান।  ছবি: বাংলানিউজ
মানিক, শাহিন, রফিক, ইসমাইল, আবদুল গফফারসহ এখানকার জেলেরা জানান, বাপ-দাদাকে দেখে নিজেরাও মাছ শিকার করেন। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মাছ শিকার করাই এখন তাদের নেশা ও পেশা। এর ওপর নির্ভর করেই তাদের জীবন চলে। তাদের বেশিরভাগই মহাজনের কাছ থেকে ঋণ ও দাদন (সুদে টাকা ধার নেওয়া) নিয়ে মাছ ধরতে যান। দাদনের টাকা তারা জাল-নৌকা তৈরি বা মেরামতে ব্যয় করেন। কেউ কেউ এনজিও’র কাছ থেকেও ঋণ নেন। ঋণ আর দাদনের টাকা পরিশোধ করতে করতেই তাদের জীবন শেষ হয়ে যায়, ভাগ্যের পরিবর্তন আর হয় না।  

এদিকে, রত্তন ফরাজী, আবদুর রশিদসহ কয়েকজন জেলে জানান, মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোনো কাজ তাদের জানা নেই। তাই বংশ পরম্পরায় দারিদ্র্যের শেকলে বাঁধা তাদের জীবন। সে কারণেই মাছ ধরতে গিয়ে জেলেদের হাত পাততে হয় মহাজন এবং আড়তদারদের কাছে। আজীবন মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের।

পাথরঘাটার সিনিয়র সাংবাদিক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ বলেন, বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় ইচ্ছা থাকলেও এ পেশা ছাড়তে পারছেন না উপকূলীয় এলাকার জেলেরা। এ সুযোগে মধ্যসত্ত্ব ভোগীরা তাদের ব্যবহার করে টাকার পাহার গড়ছে। ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরেন জেলেরা। কিন্তু সেই মাছ জমা দিতে হয় মহাজনের কাছে। এতে জেলেরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে তাদের ভাগ্যেরও উন্নতি হচ্ছে না। আবার অনেক সময় ঋণ বা দাদনের টাকায় নৌকা, জাল আর রসদ নিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে পড়তে হয় দস্যুদের কবলে। তখন ভাগ্য ভালো হলে প্রাণে বাঁচলেও মাছ, জাল, নৌকা আর রসদসহ সবই হারাতে হয়। মাছ দিয়ে ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়ে জড়িয়ে পড়েন ঋণের জালে।  

দিনরাত ২৪ ঘণ্টা শ্রম দিয়েও তারা পাচ্ছেন না শ্রমের ন্যায্য দাম ও মর্যাদা। এভাবেই জীবন এগিয়ে চলেছে উপকূলের প্রান্তিক জেলেদের।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৮
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।