ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কবি মতিন বৈরাগীর ৭২ বছরের সাধনা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৭
কবি মতিন বৈরাগীর ৭২ বছরের সাধনা কবি মতিন বৈরাগী

কবি মতিন বৈরাগীর ৭২তম জন্মবার্ষিকী সাহিত্যের পাঠকদের জন্য সুখকর। বৌদ্ধিক দীপ্তির শুদ্ধস্বরে বাংলাদেশের প্রবল কোলাহলের মধ্যে কাব্য সাধনায় অবিচ্ছিন্নভাবে নিরত থাকতে পারাটাও কম কৃতিত্বের নয়। ফলে নানা কারণে তার জন্মদিনটি গুরুত্বপূর্ণ।

আশির দশকে বাংলাদেশের কাব্যক্ষেত্র যখন প্রবলভাবে বিভাজিত, তখনও তিনি যেন একাকী ও নিঃসঙ্গ, ওয়ারম্যান আর্মির মতো স্বতন্ত্র। কারো পুক্ষপটে না গিয়ে স্বতন্ত্র পথ রচনা করেছেন।

কাব্যভাবনায়, প্রকাশ ভঙ্গিমায়, বিষয়বৈচিত্র্যে, চিন্তার বিন্যাসে খুবই অন্য রকম একজন তিনি।

বাংলাদেশের সামগ্রিক কাব্যচর্চায় একজন একাকী কবি জীবনব্যাপী গতানুগতিকতার স্রোত ঠেলে নিজস্ব একটি দ্বীপে পৌঁছে যাচ্ছেন, আর সেই দ্বীপটি কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, আড়াগোড়াই আদর্শের।

পণ্ডিত আহমদ শরীফের উক্তি- ‘কবি মতিন বৈরাগী নিজের গুণ ও দানের জন্যেই বাংলাদেশের কবিতাঙ্গনে সুখ্যাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। কাজেই তিনি তার নতুন কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা মুহূর্তে কারো মত, মন্তব্যের কিংবা তদবিরের তোয়াক্কা করেন না’।

১৬ নভেম্বর বাহাত্তরস্পর্শী কবি মতিন বৈরাগী আদর্শভিত্তিক রাজনীতির সাংস্কৃতিক রূপান্তরের পথে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ধারাবাহিকতাতে মুখ্য। তিনি তাই আদর্শের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে হার না মানা সেনাপতির মতো।

প্রপীড়িত আমজনতা অর্থে গণমানবের দাসত্ব-শোষণ-বঞ্চনাজাত বেদনার রাজনৈতিক মুক্তির জায়গাটি তার কবিতার নিরবচ্ছিন্ন অক্ষরমালায় সজ্জিত। বোধ ও চেতনার স্তরে প্রজ্ঞার অমলিন দীপ্তিও তার কবিতার বাতায়নে আলোক ছড়াচ্ছে। সক্রেটিস বা অন্য দার্শনিকের চিন্তা, জীবন, কর্মের যে কাব্যিক রূপান্তর তিনি সাধন করেছেন, সে লালিত্য মুগ্ধ করে পাঠককে। দেশজ মিথ, লোকাচার, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নবায়নের মুন্সিয়ানাও তিনি দেখিয়েছেন নবনির্মার্ণের দ্যোতনাময়। কবিতাকে প্রতিদিনের সাধারণ কর্ম নয়, জীবনযাপনের বিশ্বাসের চর্যার স্তরে উত্তীর্ণ করেই কাজগুলো করেছেন। এখানেই একজন অর্গানাইজড, মেথডিক্যাল ও সুবিন্যস্ত কবির ব্যক্তিত্ব কাঠামোটি ফুটে ওঠে।

মতিন বৈরাগীর বারোটি কাব্যগ্রন্থ হলো- 'বিষণ্ন প্রহরে দ্বিধাহীন’ (১৯৭৭), ‘কাছের মানুষ পাশের বাড়ি’ (১৯৮০), ‘খরা পীড়িত স্বদেশ’ (১৯৮৬), ‘আশা অনন্ত হে’ (১৯৯২), ‘বেদনার বনভূমি’ (১৯৯৪), ‘অন্তিমের আনন্দ ধ্বনি’ (১৯৯৮), ‘অন্ধকারে চন্দ্রালোকে’ (২০০০), ‘দূর অরণ্যের ডাক শুনেছি’ (২০০৫), ‘স্বপ্ন এবং স্বাধীনতার গল্প’ (২০০৭), ‘অন্য রকম অনেক কিছু’ (২০০৮), ‘খণ্ডে খণ্ডে ভেঙে গেছি’ (২০১২) এবং ‘দুঃখ জোয়ারের জলস্রোত’ (২০১৪)। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে ‘নির্বাচিত’ (২০০১), ‘সিলেক্টেড পয়েমস’ (২০০৫), ‘কবিতা সমগ্র’ (২০০৮), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’(২০১৫) এবং ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০১৬)। আরও আছে হামিদ রায়হান সম্পাদিত কবিতা বিষয়ক ছোট কাগজ ‘উত্তরপুরুষ- কবি মতিন বৈরাগী সংখ্যা’।

সমগ্র মতিনের মধ্যে তত্ত্ব ও প্রয়োগের ভিত্তিতে কবিতার এক নান্দনিক প্রাক্সিস দৃশ্যমান। নিজের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের স্মৃতি ও সত্ত্বার সঙ্গে সঙ্গে কাব্যকীর্তির অপূর্ব মেলবন্ধনে তিনি বাংলাদেশের কাব্যজগতের এক স্বতন্ত্র-পুরুষ, দ্বিধাহীন, ভয়শূন্য পদাতিক, শৈল্পিক যোদ্ধা। একজন সৃজনশীল মানুষের জন্য মোটা দাগের হলেও গণচেতনা, মানবিকতাবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা চৈতন্য অপরিহার্য। মতিন বৈরাগী সে চেতনাকে সাম্য ও বিপ্লবের অন্তঃস্থলে উচ্চকিত করেন।

কলাকৈবল্যবাদের ফ্যাশন নয়, তার কবিতাও সংগ্রামশীলতার অস্ত্রস্বরূপ। অবশ্যই তিনি তার স্বপ্নের উত্থান-পতন, বিপর্যয় ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে নানা আপস ও হটকারিতার ঘটনাপ্রবাহে যথেষ্ট আবেগময়। তথাপি নিরঙ্কুশ আশাবাদ ও আদর্শের প্রতি বিশ্বাসে জারিত তিনি। প্রবল বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যোজন যোজন দূরবর্তী নির্মোহ অবস্থানে থেকেও তিনি জীবনের ধ্রুবতারার মতো আদর্শের সংশ্লেষ উপভোগ করেন।

মতিন বৈরাগী স্বপ্ন ও কাব্যে মেলে ধরেন সংগ্রামশীল ধ্রুপদ জীবন। উড়িয়ে দেন প্রত্যাশার স্বপ্নপালক:
‘উড়িয়ে দিলাম সোনার পাল
বাঁচি মরি ভাঙুক হাল
বজরাতে
আমিও এবার উঠবো গো
হরহামেশা ছুটবো গো
মাঝরাতে
সবুজ ডালের টিয়েটা
শ্বেত ভালুকের বিয়েটা
ভাঙবে যে
রাত্রি-দিন নেই আহার
হানবো আঘাত ভাঙবো দ্বার
ভাঙবো হে’ ॥

(উচ্ছ্বাস ॥ বিষণ্ন প্রহরে দ্বিধাহীন)

মুদ্রার উল্টোপিঠে যে যাতনা ও বেদনার চলচ্ছবি, তাও অব্যক্ত নয় মতিনের কাব্যচেতনায়:
‘দীর্ণ করে রাত্রি, কাতরায়-গোঙায় পৃথিবী পাঁজরে
এবং সকল স্নিগ্ধতা ঝেরে ফেলা এক ভোর
পূর্বরাত্রির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে জন্মান্ধের মতো চোখ মেলে
হিমস্পর্শের মতো স্মৃতিগুলো নড়ে-
যদিও তারপর চাকার ঘর্ঘর ইস্পাত পোড়ে-
আরো কতোক রাত্রিকে ভেদ করবে বলে থমকে থাকা
মশারীকে উসকে দিয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে।

(বিপন্ন এক রাত্রির গল্প॥ দুঃখ জোয়ারের জলস্রোত)

বাংলাদেশের মতো অতি দ্বিধান্বিত ও ত্রস্ত সমাজে একজন কবি প্রচণ্ড নিভৃতে, নিঃসঙ্গতায়, মোহমুক্ত ও পক্ষমুক্ত থেকে নিজের আদর্শ ও কাব্য সংগ্রামকে সুদীর্ঘ  বছরের পরিধিতে টেনে টেনে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন- জীবন সংগ্রামশীল, মানুষ অপরাজেয়। প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের প্রযত্নকে থু থু ছিটানো এবং গতানুগতিকদের পরিপোষণের বেবিফিডিং চর্চার (পড়ুন কবিফিডিং) পশ্চাৎদেশে কষে মারার জন্য আর কিছুর প্রয়োজন হয় না।

জীবন ও কবিতার মধ্য দিয়ে মতিন বৈরাগী হইজাগতিকতার ক্ল্যাসিক্যাল শিক্ষাটিরই বিস্তার ঘটিয়েছেন যে, রেঁনেসা পরবর্তী মানুষ শত বিরূপতাতেও নিজেকে বিনির্মাণ করবে, বিকশিত করবে, আত্মচেতনার পরিচিতিকে অর্জন করবেই, গোত্রভুক্ত ঝাঁকের কৈ-এর মতো ‘চেলা’ হবে না।

স্বাধীন ও সার্বভৌম চিত্তে কবি মতিন বৈরাগীর ৭২তম জন্মবার্ষিকী উদ্‌যাপিত হবে অপরাজেয় কবি ও কাব্যধারার হার না মানা স্রোতে, বাংলাদেশের কেন্দ্র ও প্রান্তে প্রান্তে, বিশ্বায়নের অসীমান্তিক ভূবনের ধুলি ও মেঘে মেঘে ছাওয়া আমাদের সবুজ পৃথিবীতে।

কবিকে অন্তহীন শুভেচ্ছা।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও কথাশিল্পী। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৭
এমপি/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।