ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

ঘাতক ব্যাধি নিরাময়ে সয়াবিনের বিস্ময়কর প্রভাব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
ঘাতক ব্যাধি নিরাময়ে সয়াবিনের বিস্ময়কর প্রভাব সয়াবিনের নানা পদ। ছবি: সংগৃহীত

সারা বিশ্বে মানব স্বাস্থ্য নানাবিধ ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা হঠাৎ আবির্ভূত কিছু প্রাণঘাতী রোগের প্রাদুর্ভাবে জর্জরিত। খাদ্যের প্রায় ৯৮ % ভেজালের বেড়াজালে আবদ্ধ। তবে মানব উন্নয়নের  কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়।

মোটামুটি সফল ইপিআই কর্মসূচির কারণে শিশু মৃত্যুর হার কমে এসেছে। মাতৃ মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার উদ্যোগও সাফল্য অর্জন করছে।

কিন্তু সেই তুলনায় দেশে পুষ্টি পরিস্থিতি আশানুরূপ নয়।

পুষ্টি কর্মসূচিতে সয়াবিনের অন্তর্ভুক্তি সময়ের দাবি

সম্প্রতি ব্র্যাক আয়োজিত গোলটেরিল বৈঠকে অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের খারাপ পুষ্টি পরিস্থিতির বিষয়টি আলোচিত হয়। দেশে ছয় লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার। ৪১ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। প্রায় ৩৬ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। ৪০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির। ৪৫ শতাংশ শিশুর গড় ওজন কম। এ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

পুষ্টির অভাবে শিশুরা অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত হয়। প্রতিবছর প্রতিরোধযোগ্য জটিলতায় ৫৩ হাজার শিশু মারা যায়। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিসেস কোলাবরেশন-এর গবেষণা প্রতিবেদনে যে তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়, সেগুলো হলো- বৈশ্বিকভাবে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্যান্সার বৃদ্ধি হয়েছে ৩৩ শতাংশ। একই সময়ে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এই বৃদ্ধি ছিল ৫০ শতাংশ। তবে অতি উন্নত দেশগুলোতে নতুনভাবে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ৪৪ শতাংশ। কারণ গবেষণার মাধ্যমে জানা গেছে যে, খাদ্যের বিশেষ উপাদানের আধিক্যের কারণে অনেক প্রাণঘাতী রোগ হতে পারে।

সয়াবিন ক্ষেত।  ছবি: বাংলানিউজআবার খাদ্য বিশেষজ্ঞরা এ কথাও বলেন যে, বিশেষ কোন খাদ্য অথবা খাদ্য উপাদান মানুষের অনেক প্রাণঘাতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা প্রদান করে। সয়াবিন হল এ ধরনের একটি খাদ্য উপাদান যা শুধু পুষ্টির দিক দিয়েই অনন্য নয়, অনেক ভয়ানক রোগ প্রতিরোধেও এর রয়েছে অসীম ক্ষমতা। নিম্নে মানব কল্যাণে ঘাতক ব্যাধি নিরাময়ে সয়াবিনের বিষ্ময়কর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

ক্যানসার
১৯৯০ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্ব জুড়ে সহস্রাধিক গবেষণা পরিচালিত হয় এমন একটি মূল্যবান খাদ্য যৌগের জন্য যা ক্যানসার প্রতিরোধে সক্ষম হতে পারে। গবেষকদের মধ্যে এই বিশ্বাসবোধ সৃষ্টি হয় যে, সয়াবিনে বিদ্যমান আইসোফ্লাভিন এর কারসিনোজিনিক প্রতিরোধী  ক্ষমতা  থাকার কারণে ক্যানসার সম্প্রসারণে যে এসট্রোজেনগুলো কাজ করে সেগুলোর ক্ষমতা বিলুপ্ত করে ক্যানসার প্রতিরোধ করে। প্রোস্টেট ও কোলন ক্যানসারের বিরুদ্ধে এই আইসোফ্লাভিন থেরাপির মত কাজ করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, সয়াবিনে বিদ্যমান জেনিসটিইন প্রোস্টেট ও কোলন ক্যানসারের কোষ বৃদ্ধি প্রতিহত করে, নতুন টিউমার পিন্ডের বৃদ্ধি ধ্বংস করে ক্যানসারের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে মানুষকে ক্যানসারের মত ঘাতক রোগ থেকে রক্ষা করে।

সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী এক কোটি ৭৫ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে ৮৭ লাখ লোক মারা যায়।

গরেষকদের মতে, কার্ডিও ভাসকুলার রোগের পর ক্যান্সার বৈশ্বিকভাবে মানব মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। প্রাণঘাতী এসব মারাত্মক রোগ থেকে আরোগ্য লাভের ক্ষেত্রে রোগীর খাদ্যাভাস , মূল্যবান পুষ্টিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ এবং বাসস্থানগত বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক দলের প্রধান ক্রিস্টিনা ফিটজমরিচ এর মতে, বাস্তবিক পক্ষে ক্যান্সারের বিভাজন খুব দ্রুত হয়। অত্যানুধিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সমৃদ্ধ উন্নত দেশেও রোগীর শরীরে রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে স্বল্পোন্নত দেশে দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য রোগটির বিভাজনগত বৃদ্ধি ঘটে তার চাইতেও অনেক বেশি।

গবেষক দল ১৯৫টি দেশের শিক্ষা, আয় এবং জন্মদানে সক্ষমতার ন্যায় সমন্বিত সামাজিক জনতাত্ত্বিক  সূচক- এর উপর ভিত্তি করে ৩২ ধরনের ক্যান্সার নিয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। যেখানে বৈশ্বিকভাবে স্তন, রক্তনালী এবং ফুসফুস ক্যান্সারের সংখ্যা সর্বাধিক। এর বাইরে কোলন, মলদ্বার, পাকস্থলি এবং লিভার ক্যান্সারে বিশ্বে প্রতি বছর ১২ লাখ লোক মারা যায়-যা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণার সবচাইতে উদ্বেগজনক তথ্যটি হলো-নারীদের জন্য সবচাইতে প্রাণঘাতী রোগ স্তন ক্যান্সারে ২০১৫ সালে সাড়ে ৫ লাখ নারীর মৃত্যু হয়। তাই ক্যান্সার প্রতিরোধে সয়াবিনে বিদ্যমান আইসোফ্লাভিন এর কারসিনোজিনিক প্রতিরোধী  ক্ষমতা  সম্পন্ন খাদ্য গ্রহণ করে ক্যান্সার প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন।
সয়াবিনের ক্ষেত।  ছবি: বাংলানিউজ

হৃদরোগ
আমেরিকান বিজ্ঞানী ড. জেমস এনডারসন ১৯৯৫ সালে তাঁর এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ করেন যে, সয়া প্রোটিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে ৯.৩ %  সিরাম কোলেস্টরল, ১২.৯ % এলডিএল কোলেস্টরল এবং ১০.৫ % সিরাম ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়। পক্ষান্তরে, ২.৪ % এইচডিএল কোলেস্টরলের (ভাল কোলেস্টরল) মাত্রা বৃদ্ধি করে।

এই ফলাফল থেকে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন যে, সিরাম কোলেস্টরলের এই পরিবর্তন করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি ১৮-২৮ % হ্রাস করে।

ড. জেমস এনডারসন এ সিদ্ধান্তে উপণীত হন যে, সয়াপ্রোটিন এলডিএল কোলেস্টরল কমানোর ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী ওষুধ হিসাবে অত্যন্ত কার্যকর।

সয়াবিন ক্ষেত।  ছবি:বাংলানিউজতিনি আরো উল্লেখ করেন যে, সয়াবিন তেলে ৫০% অত্যাবশ্যকীয় লিনোলিক এসিড (বহুমুখী অসম্পৃক্ত ফ্যাট) বিদ্যমান থাকাতে মোট সিরাম কোলেস্টরলের মাত্রা হ্রাস করে এবং ৮-১২ % লিনোলিনিক এসিড (ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড) থাকার কারণে হৃদরোগ ও ক্যানসারের প্রবণতা বা ঝুঁকি হ্রাস করে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড এর অন্যতম একটি উদ্ভিদজাত উৎস হলো এই বিষ্ময়কর সয়াবিন।

হাড়ের ক্ষয়রোগ
সয়া খাদ্য গ্রহণের ফলে হাড়ের ক্ষয়রোধ হ্রাস করে হাড় পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করে। সয়া আইসোফ্লাভিন জেনিসটিইন হাড়ের ক্ষয়রোধ প্রতিরোধ করে হাড়, ঘাড় ও কোমরের গিট ব্যথা হ্রাস করে।

সয়াবিনে যথেষ্ট পরিমাণ ক্যালসিয়াম (২৫০ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম) থাকার কারণে বৃদ্ধদের হাড় রোগের প্রতিরোধী ওষুধ হিসাবে কাজ করে। এ কারণে সয়া দুধ, সয়া আটা, সয়া ময়দা ও সয়া সুজিকে ক্যালসিয়ামের একটি সমৃদ্ধ উৎস বলা হয়।

অপুষ্টিজনিত রোগ
সকল ডাল জাতীয় দানা শস্য থেকে সয়াবিনে দ্বিগুণ (শতকরা ৪০-৪৪ ভাগ) প্রোটিন থাকার কারণে দুধ ও মাংস উৎপাদনে ব্যবহৃত খাদ্যের সাথে সয়াবিন ব্যবহার করা হলে প্রায় ১৫ গুণ বেশি দুধ ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে অপুষ্টিজনিত রোগ দমনে সয়াবিন এক কার্যকর মহা ওষুধ। সয়াবিনে ফাইটেক্যামিকেল জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান থাকার কারণে যাবতীয় অপুষ্টিজনিত রোগ প্রতিরোধ করে গরীব ও দুস্থ লোকদের সুস্বাস্থ্য প্রদানে বিরাট ভূমিকা পালন করে। এজন্য অপুষ্টি দূর করার লক্ষ্যে ময়দা, আটা, সুজি, মাছ, মাংস, ডাল, তরি-তরকারি ইত্যাদিসহ অন্যান্য খাদ্য বস্তুর সাথে সয়াপ্রোটিন যুক্ত করা হলে অপুষ্টিজনিত রোগের হাত থেকে গোটা জাতি মুক্তি পাবে।

মানব মস্তিষ্কে সয়াবিনের প্রভাব
সয়াবিনে বিদ্যমান কোলিন বা কোলাইন নামক রাসায়নিক পদার্থ মেধাশক্তি বাড়ায়। যার কারণে আমেরিকায় ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সয়াবিনের খাদ্য উপজাত খাওয়ানো বাধ্যতামূলক। অথচ আমাদের দেশে এ ব্যাপারে কোন সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি।
 
পরিশেষে বলা যায়, ঘাতক ব্যাধি বিশেষ করে নতুনভাবে ক্যান্সার বৃদ্ধি আগামী দশকে স্বাস্থ্যখাতের উপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে স্বল্প-সম্পদের দেশগুলোর জন্য এই চাপ মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে যাবে।   তাই মানব কল্যাণে ঘাতক ব্যাধি নিরাময়ে সয়াবিনের খাদ্য-উপজাত ব্যবহার করে এই পরিস্থিতির উন্নয়নে-সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিরোধ প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বিএআরআই, নোয়াখালী।

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।