ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

নুন ফিরেছে নিজ গুনে, বেশি খেলে ক্ষতি নেই

স্বাস্থ্য ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৭ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৭
নুন ফিরেছে নিজ গুনে, বেশি খেলে ক্ষতি নেই লবন

লবন কি তার নিজ গুনে ফিরলো? এই প্রশ্নটি করাই যায়। পাতের কোনে লবন রেখে ভাত খেতে বসা যে বাঙালির অভ্যাস ছিলো তা ধীরে ধীরে উবে গেছে এই জেনে যে, লবন ক্ষতিকর। লবন হার্ট অ্যাটাকের কারণ। 

লবনেই বাড়ে প্রেসার। এভাবেই চলেছে চল্লিশটি বছর।

আমাদের বলা হয়েছে ‘লবন খেয়েছো তো মরেছো’। ডাক্তাররাতো এই বলতেও ছাড়েননি- ধূমপানের মতোই সমান ক্ষতিকর লবন। সে কারণে খাদ্যায়োজনে লবনের পরিমাপ নিয়ে নানা তত্ত্ব-তথ্যও দেওয়া হয়েছে।  

বলা হতো- ‘দিনে মোট এক চা-চামচ লবন, তার বেশি নয়। ’ কারণ একটা সুন্দর, আনন্দময় জীবন কে না চায়? মুখে সামান্য স্বাদকে বর্জন করে ভালো থাকার জন্য আলুনি খাদ্যাভ্যাস গড়ে নিয়েছেন অনেকেই।

কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন কি বলছেন! তারা বলছেন ও সবই ভুল কথা। নুন নিয়ে যা কিছু বলা হয়ে আসছে তা ভুল। নুন খেলে ক্ষতিতো হয়ই না, বরং নুন না খেলে কতিপয় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। আপনার মোটা হয়ে যাওয়ার কারণ নাকি এই নুন না খাওয়া। আর যৌনশক্তিও নাকি কমে যায় তাতে!

যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরির সেন্ট লিউক’স মিড-আমেরিকা হার্ট ইন্সটিটিউটের গবেষকরা তাদের দীর্ঘ গবেষণালব্দ জ্ঞান থেকে এসব বলছেন। গবেষকরা জানাচ্ছেন তারা লবন নিয়ে ব্যাপক লেখাপড়া করেছেন, চালিয়েছেন অনুসন্ধান। তাতে দেখেছেন লবন কম খেতে বলার পক্ষে একটিও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং উল্টোটাই তাদের কাছে ধরা পড়েছে। অতি স্বল্প পরিমান লবন খাওয়ার কারণে শরীরে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা কমে যায়, মেদ জমে যায় এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আর এমনকি যৌনতায় আগ্রহ ও শক্তি দুইই কমে এই কারণে।  

লবন গ্রহণের বর্তমান মাত্রা ২.৪ গ্রাম সোডিয়াম, অর্থাৎ লবন বা সোডিয়াম ক্লোরাইড মোট ৬ গ্রামের বেশি নয়। যা এক চা চামচের চেয়ে সামান্য কম। যদি কোনওভাবে আপনার রক্তচাপ উচ্চ হয়, আর বয়স হয় ষাটের বেশি তাহলেতো কথাই নেই। অ্যাফ্রো-ক্যারিবিয়ান চিকিৎসকরাতো আরেকটু কড়া। তারা বলে দেন এক চা-চামচের তিনভাগের দুইভাগ পর্যন্ত লবন গ্রাহ্য। কেউ কেউ তো আধা চা-চামচ বরাদ্দ করতে চান। বিষয়টি এখন গোটা বিশ্বেরই অনেকটা একই রবম।  

কিন্তু নতুন গবেষণা বিজ্ঞানীরা বলছেন, লবনতো আমাদের শরীরের পুষ্টির সাথেও সম্পর্কিত। এবং তা জীবনের সাথেও। ফলে এই যে সামান্য লবনের পরামর্শ- তা আমাদের শরীরের কিছু প্রাকৃতিক শক্তিকেই খর্ব করে।

তারা বলছেন, লবন খাওয়ার আকুতিটা অনেকটা পানির তৃষ্ণার মতো। আলুনি খাবার অনেকে খেতেই পারেন না। কারণ শরীরের গড়নই লবন চায়।  

আমরা বস্তত লবনময়। আমাদের কান্নায় লবন, ঘামে লবন, আর আমাদের শরীরের কোষগুলোও লবনাক্ত তরলের মাঝেই ডুবে থাকে। লবন ছাড়া আমাদের জীবনই চলে না।

শুধু মানুষ কেনো পশুর ভেতরেও লবনের আকুতি প্রকট। গরুতো আলুনি মাড়, খড়, খৈল এমনকি পানিটুকু পান করতে চায় না। কেনিয়ায় অতিকায় হস্তিগুলো মাউন্ট এলগনের অন্ধকার গুহাপথ ধরে হেঁটে গিয়ে তার দেয়াল ভেঙ্গে সোডিয়াম সালফেট বের করে আনে। গরিলাগুলো হাতির পথ ধরে পড়ে থাকা লবনে নিজেদের চাহিদা মেটায়। আর বানরগুলো হাতির পীঠ চেটে লবন খায়।

লবন জীবন ধারণের এক মৌলিক উপাদান। এর ঘাটতি প্রাকৃতিক জন্মনিরোধের কাজ করে। তা মানুষসহ সকল প্রাণির জন্য প্রযোজ্য। লবন কম খেলে আপনার যৌন শক্তি কমে যাবে, গর্ভবতী হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দেবে, এবং কম ওজনের শিশু জন্মদানের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে।  

ক্লিনিক্যাল স্টাডিগুলোতো এও দেখাচ্ছে কম-লবনের খাদ্যাভ্যাস নারীর সন্তানধারণের উপযুক্ত সময়টিতে অবসাদগ্রস্ত করে দেয়, যৌনাচারেও এনে দেয় অনীহা।

বরং শরীরে পর্যাপ্ত লবনের উপস্থিতি আপনাকে এসব সমস্যা থেকে মুক্তিতো দেয়ই- আপনি দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত হলে তা সহ্য করার, পার্থিব কোনও কারণে আপনার মনের ওপর চাপ পড়লে তা ধারণ করার ক্ষমতাও দেয়।  

যে লবনকে হৃদরোগের কারণ বলা হতো এখন বরং বিজ্ঞানীরা বলছেন, আপনার হৃদযন্ত্র যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন তাতে রক্ত সঞ্চালনে শরীরে জমে থাকা লবন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

তাহলে কেনেই চিকিৎসকরা বলে আসছেন লবন ক্ষতিকর?

প্রথাসিদ্ধ চিকিৎসা শাস্ত্র লবন নিয়ে যা বলছে তা স্রেফ একটি উপপ্রমেয় (হাইপোথিসিস)। বলা হয়, বেশি মাত্রায় লবন খেলে রক্তের উচ্চচাপ বাড়বে- ব্যাস মেনে চলুন।  

তবে স্বাস্থ্যের সাধারণ তত্ত্বগুলো ঘেঁটে বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, এটা একটা মৌলিক ভুল ধারণাপ্রসুত, ভুল বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় সম্মৃদ্ধ। সহজ হাইপোথিসসটা এমন- লবন খেলে আমাদের পানির তৃষ্ণা পায়, ফলে আমরা পানি বেশি পান করি। আর বেশি পানি পান রক্তের লবনাক্ততা পাতলা করে দেয়, তাতে রক্তের ঘনত্ব বাড়ে আর তা থেকেই তৈরি হয় উচ্চ রক্ত চাপ। সেই থেকে হৃদরোগ, পক্ষাঘাতসহ অন্যান্য জটিল সমস্যা।

এই যে বলা- এর কোনও তথ্যনির্ভর ব্যাখ্যা নেই। বরং স্বাভাবিক রক্তচাপের (নিচে ৮০ উপরে ১২০) মানুষগুলো লবন খাওয়া বাড়িয়ে দেওয়ায় তাদের রক্তচাপ বেড়ে গেছে এমন একটি ঘটনাও চিকিৎসকদের জানা নেই।

লবন রক্তচাপ বাড়ায় এই বিপজ্জনক মিথটি শুরু হয়েছে ১০০ বছর আগে। ফরাসি দুই বিজ্ঞানী আমবার্ড ও বুচার্ডের মাধ্যমে। মোটে ছয় জন রোগীর ওপর গবেষণা চালিয়ে তারা এই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।

পরবর্তী গবেষকরা তাদের ওই গবেষণার তথ্যগুলোর ভুল ব্যাখ্যা ও ভুল ব্যবহার করে গেছেন, যা গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই একটি মিথ ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, যা ক্ষতিকর। এমনটাই বলছেন নতুন গবেষকরা।   

তারা বলছেন, আপনি যদি হঠাৎ করে লবন খাওয়া কমিয়ে দেন, আপনার শরীরে আয়োডিনের স্বল্পতাও দেখা দিতে পারে। কারণ লবনেই আমাদের আয়োডিনের অন্যতম উৎস। থায়রয়েডের সঠিক কার্যকারিতার জন্য এই আয়োডিন আমাদের প্রয়োজন। আর থায়রয়েড ঠিক মতো কাজ না করলে মেটাবোলিক রেট কমে যায়। আর মেটাবোলিকের কম মাত্রা শরীর মুটিয়ে দেয়, বিশেষ করে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোয় মেদ জমে। ফলে তা ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা কমায়, তাতে ওজন বাড়ে।

এছাড়াও কম-লবনের খাবার শরীরে পানিশূন্যতা বাড়িয়ে দেয়। তাতে কোষগুলো পানিশূন্য হযে পড়ে আর শক্তি হারায়। তাতে শরীরে দুর্বল বোধ হয়। চাঙ্গা হতে বেশি ক্যালোরি নেওয়া হয়ে যায়। আর তাতেই বাড়ে ওজন।

সুতরাং লবনেই ভরসা।  

বাংলাদেশ সময় ১০৫৪ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৭
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।