ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

ভ্যালেন্টাইনস ডে স্পেশাল

ভালোবাসা বনাম ভালোবাসা

ডা. সানজিদা শাহরিয়া | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
ভালোবাসা বনাম ভালোবাসা ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: ‘সখি ভালোবাসা কারে কয়’ রবীন্দ্রনাথের এ পংক্তি মানুষের মনে নানা রূপে, নানা ছলে উঁকি দিয়েছে। দেহজ প্রেম, মনোজ প্রেম, ঐশ্বরিক প্রেম বৃত্তবন্দি হয়ে গেছে একমাত্র মানুষের মস্তিষ্কের এই ভালোবাসার ঘেরাটোপে।

তাই শুধু মানুষই বলতে পারে-

‘প্রিয়জনে যাহা দিতে চাই
তাই দেই দেবতারে,
দেবতারে যাহা দিতে চাই,
তাই দেই প্রিয়রে,
আর পাবো কোথা?
দেবতারে প্রিয় করি,
প্রিয়ে-রে দেবতা’

প্রেমতত্ত্ব
মনস্তাত্ত্বিক ও গবেষকরা নানা রকমভাবে প্রেমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রেম একটি মৌলিক মানবীয় আবেগ। কিন্তু কীভাবে ও কেন এটি অনুভূত হয়- তা ব্যাখ্যা করা বেশ জটিল। ঠিক যেনো কবিগুরুর ভাষায়, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। বহুদিন ধরে বহু মনীষী প্রেমকে প্রাচীন, রহস্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক অনুভূতি হিসেবে বিবেচনা করে এসেছেন।

প্রেমতত্ত্বের প্রকারভেদ

ভালোবাসা বনাম ভালোবাসা: রোমান্টিক ভালোবাসা তিনটি উপাদান দিয়ে তৈরি। সংযুক্তি-আসক্তি, যত্ন ও আন্তরিকতা। সংযুক্তি-আসক্তির ক্ষেত্রে দরকার কারও যত্ন নেওয়া বা কারও কাছে থেকে যত্ন পাওয়া। কারও সম্মতি নিয়ে বা কাউকে সম্মতি দিয়ে দৈহিকভাবে স্পর্শ করা। যত্ন সুনিশ্চিত করে অন্যের প্রয়োজন ও খুশিকে নিজের খুশি বা নিজের প্রয়োজন বলে ভাবতে। আন্তরিকতা ইচ্ছা, চিন্তা, অনুভূতি ও ভাবের আদান-প্রদানকে জায়গা করে দেয়।

দরদী ভালোবাসা বনাম কামুক ভালোবাসা: দরদী ভালোবাসায় পারস্পারিক শ্রদ্ধা, সংযুক্তি, স্নেহ ও বিশ্বাস থাকে। এখানে উভয়ের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক এবং নিরাপত্তা ও স্থায়ীত্ব থাকে।

কামুক ভালোবাসা তীব্র অনুভূতি, যৌন আকাঙ্ক্ষা, দুশ্চিন্তা ও আকর্ষণের ভিত্তিতে স্থাপিত থাকবে। উভয়েই উল্লাসিত ও তৃপ্তবোধ করবে। এ ধরনের সুতীব্র প্রেমের স্থায়ীত্ব তিন মাস থেকে ৩০ মাস পর্যন্ত থাকে। এরপরও যদি এই প্রেম টেকে যায় তবে এটি ধীরে ধীরে দরদী ভালোবাসায় রূপ নেয়। ধীরে ধীরে সম্পর্কটি নিরাপদ স্থায়ীত্বের দিকে গড়ায়। তবে কদাচিত এ ঘটনা এক্ষেত্রে ঘটে।

প্রেমতত্ত্বে বিবেচ্য বিষয়
ভালোবাসা কি একটি সম্পূর্ণ অনুভূতি? নাকি বিভিন্ন অনুভূতির সুষম বিন্যাস? গবেষণায় দেখা গেছে, ভালোবাসায় বিভিন্ন উপাদান ও নিয়ামক রয়েছে।

ভালোবাসার ধরন
ভালোবাসার ধরন রয়েছে। প্রাথমিক ধরন তিনটি।

ইরোস, অর্থাৎ যৌন গন্ধিবন্ধন।
লুডোস, অর্থাৎ এক ধরনের খেলা।
স্টোরজ, অর্থাৎ সনানুভূতির বন্ধন (উভয় ব্যক্তির বোধ একই রকম হয়)।

এদের নানাভাবে সাজালে নানামুখী প্রেম হয়।

ম্যানিয়া> ইরোস ও লুডোস’র সমন্বয়। অর্থাৎ জেদ ও ঈর্ষাযুক্ত ভালোবাসা।

প্রাগমা > লুডোস ও স্টোরজ’র সমন্বয়। অর্থাৎ বাস্তবমুখী ভালোবাসা।

অ্যাগাপে> ইরোস ও স্টোরজ’র সমন্বয়। অর্থাৎ নিজেকে বিলীন করে ভালোবাসা, যেমন ঈশ্বরকে ভালোবাসা।

প্রেমের ত্রিভূজতত্ত্ব
সব ধরনের ভালোবাসায় তিনটি উপাদান থাকে।

অন্তরঙ্গতা, নৈকট্য: এর মাধ্যমে দুইজন মানুষ কাছে আসে ও নিজেদের অনুভূতিগুলোর যত্ন নেয়।

উষ্ণতা, আবেগ: এর ফলে দৈহিক ও মানসিক উন্মেষ বা আরও কাছে আসার আগ্রহ তৈরি হয়। যা মানসিক ভালোলাগা থেকে যৌনতা পর্যন্ত বিস্তৃত।

অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি: পারস্পারিক বিশ্বস্ততা রক্ষার প্রচেষ্টা।

বিজ্ঞানীরা এ তিনটি উপাদানের সংমিশ্রণকে বলছেন প্রেমের ত্রিভূজতত্ত্ব।

এভাবে দেখলে ভালোবাসাকে আট ভাগ করা যায়।

প্রেমহীন ভালোবাসা (নন লাভ): অন্তরঙ্গতা বা নৈকট্য, উষ্ণতা বা আবেগ ও অঙ্গীকার বোধের খামতি।

পছন্দ (লাইক): শুধু অন্তরঙ্গতা বা নৈকট্যবোধের অধিক্য।

বিমুগ্ধতা (ইনফ্লাচুয়েশন): উষ্ণতা বা আবেগের ছড়াছড়ি।

শূন্য ভালোবাসা (এম্পটি লাভ): দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা।

রোমান্টিক ভালোবাসা: অন্তরঙ্গতা বা নৈকট্য ও উষ্ণতা বা আবেগের সংমিশ্রণ।

সহচার্য ভালোবাসা (কমপ্যানিওনেট লাভ): আন্তরিকতা বা নৈকট্য ও অঙ্গীকারের মধুর মিশ্রণ।

বুদ্ধিহীন ভালোবাসা (ফ্যাচুয়াস লাভ): উষ্ণতা বা আবেগ ও অঙ্গীকারের মিশ্রণ।

সম্পূর্ণ ভালোবাসা (কনজুমেট লাভ): তিনটি উপাদানের সুষম মিশ্রণ।

ভালোবাসা কেন প্রেমিক-প্রেমিকা ও বন্ধু বা পারস্পারিক সম্পর্ক ভেদে ভিন্ন মাত্রা পায়?

গবেষণায় প্রমাণিত, অন্তরঙ্গতা, মানসিক সংযোগ ও নৈকট্য সব ভালোবাসার মূলমন্ত্র। তাহলে প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের তীব্রতা বা বোনের জন্য ভাইয়ের অনুভূতির ভিন্নতা বা বন্ধুর জন্য বন্ধুর অনুভূতির রকমফের কেন হয়?

এই সম্পর্ক ভেদে ভালোবাসার ভিন্নতা বা রকমফেরের জন্য দু’টি উপাদান প্রধান ভূমিকা পালন করে। একটি হলো, উষ্ণতা ও অন্যটি হলো, অঙ্গীকার। এটি সহজেই অনুমেয়, সব প্রেমের সম্পর্কেই অন্তরঙ্গতা উপাদানটি প্রচুর পরিমাণে থাকে।

রোমান্টিক প্রেমে দেখা যায়, আবেগে আবেগে মাখামাখি আবার এই রোমান্টিক ভালোবাসা যখন পারস্পারিক স্থায়ীত্ব পায় তখন এখানে অঙ্গীকারবোধের প্রাচুর্য দৃশ্যমান। দেখা গেছে, যদি অন্তরঙ্গতাকে বাদ দেওয়া যায়, তবে সমস্ত কাছের মানুষের সম্পর্কের মূলোচ্ছেদ হয়। শুধু তাই নয়, প্রেমিক বা প্রেমিকা, বন্ধুত্ব বা পারস্পারিক যেকোনো ধরনের ভালোবাসা সমূলে উৎপাটিত হয় অন্তরঙ্গতাকে বাদ দিলে।

রোমান্টিক ভালোবাসা কি দেশ-কাল ভেদে অপরাজেয়?
যুথবদ্ধ বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজের জীবন যাপনের মানে ও মাত্রায় সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। যুথবদ্ধ সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এখানে পারস্পারিক মান, সম্মান, ব্যক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এমন সংস্কৃতি এশিয়া মহাদেশে বিস্তৃত, বাংলাদেশেও তাই এর ব্যপ্তি বিশাল।

অন্যদিকে ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তিই মূখ্য। যেমন, আমেরিকান সমাজ। যুথবদ্ধ সমাজে তাই আজও পারস্পারিকভাবে পাত্র-পাত্রী দেখা চলে। এখানে আগে বিয়ে হয় পরে ভালোবাসা। কিন্তু ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজে এটি যুথবদ্ধ সমাজে রোমান্টিক বিমুগ্ধ ভালোবাসার চর্চা অপেক্ষাকৃত কম ও এখানে মানুষ বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। প্রেমের চেয়ে পাত্রর পকেটের ওজন বা পাত্রীর বাবার প্রদেয় যৌতুকের পরিমাণ এখানে অনেক বেশি সাবলীল ভূমিকা পালন করে। সেইসঙ্গে জাত-পাত বা সামাজিক অবস্থান অটল স্তম্ভের মতো মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

কিন্তু মুদ্রার অন্যদিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজে জীবনসঙ্গীর প্রতি মানসিক ও যৌন আকর্ষণ, আবেগ ইত্যাদি মুখ্য ভূমিকা পালন করে ভালোবাসার উপাদান হিসেবে।

যারা দ্রুত প্রেমে পড়ে
গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে, এসব পুরুষের ভাবনা। তাই কবিগুরু শত বছর আগে লিখে গেছেন, ‘রমনীর মন সহস্র বৎসরের সাধনার ধন’। বেশিরভাগ নারী ওয়াল্ট ডিজনির রাজকন্যার মতো ভালোবাসা ও সম্পর্কের গাঁথুনি চায়। আর পুরুষ চায় যৌনতা। পুরুষদের রোমান্টিক আবেগে তিনটি জিনিসের সমন্বয়- চেহারা, কাজ ও দৈহিক শক্তি। ভাবুন, সালমান খানের বয়স ৮০ বছর বেড়ে গেছে, মোটেও আর রোমান্টিক দেখাবে না।

অধিকাংশ পুরুষের কাছে আগে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারী অনুভূতি প্রকট। তাই প্রথম দর্শনেই প্রেম তাদের ক্ষেত্রে সম্ভব। এখানে কিন্তু পুরুষদের দোষী ভাবার কারণ নেই। তাদের মস্তিষ্কের গঠন এমন অনুভূতি তৈরিতে কাজ করে।

নারীরাও চেহারা দেখে। কিন্তু তাদের বিবেচনার তালিকায় চেহারার বাইরে আরও অনেক কিছু থাকে। তাদের ডিএনএ-তে রয়েছে, গর্ভাবস্থায় ও গর্ভ পরবর্তী সময় নারী ও তার সন্তানকে রক্ষা করবে পুরুষ। তাই তারা শক্তিশালী পুরুষকে পছন্দ করবে। আধুনিক পুরুষ লাঠি হাতে বাঘ মারতে যাবে না, তাই পুরুষের বেতন, ক্ষমতা ইত্যাদি নারীকে ও তার সন্তানকে নিরাপত্তা দেবে এমনটিই তার মস্তিষ্ক ভাবে।

এমনকি চাকরিজীবী নারীরাও সচেতনভাবে ভালো উপার্জনক্ষম স্বামী খোঁজেন। এটি আর কিছুই নয়, নারী মস্তিষ্কে সেই অদম্য ডিএনএ সংকেতের অনুরণন।

ভালোবাসা নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক কাব্য, গবেষকরা ব্যস্ত গবেষণায়। তারপরও ভালোবাসার তুলনা ভালোবাসাই। জয়তু ভালোবাসা।

ডা. সানজিদা শাহরিয়া
বিভাগীয় প্রধান ও প্রফেসর অব এনাটমি এবং কাউন্সিলর

বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৬
এটি/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।