ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

শিশু-কিশোর মনোরোগ: ‘কে বেশি আদর করে, আব্বু না আম্মু ?’

ডা. মো. সালেহ উদ্দীন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪২ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৩
শিশু-কিশোর মনোরোগ: ‘কে বেশি আদর করে, আব্বু  না আম্মু ?’

কোনো শিশুকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তোমাকে কে বেশি আদর করে, আম্মু না আব্বু তাহলে খুব সহজেই উত্তরে সে বলবে  “দুজনেই ভালোবাসে/আম্মু বেশি/আব্বু বেশি”। এমন উত্তর বুদ্ধিদীপ্ত মনে হলেও এটা সন্তানের সহজাত প্রতিক্রিয়া।

প্রকৃত প্রস্তাবে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের ভাব বিনিময় বা প্রকাশের ধরণে ভিন্নতা থাকলেও বন্ধন স্থাপনে দু’জনের ভূমিকা অনস্বীকার্য ।

শিশুদের সঙ্গে বাবা-মায়ের সম্পর্ক স্থাপনের মূল কারণই হলো তারা তার মৌলিক চাহিদার যোগানদাতা। যা শিশুকে বাবা মায়ের প্রতি আস্থাশীল করে তোলে। শিশু চায় কিছুটা মনোযোগ, ভালবাসা এবং স্বস্তির জায়গা। বাবা-মায়ের কাছ থকে শিশু  তেমনই এক ক্ষেত্র খুঁজে পায় যেখানে সে নির্ভার থেকে চারপাশ ঘুরে বেড়াতে পারে।  

মানব মনস্তত্ত্ব অনুসারে শিশুদের সামাজিক হয়ে বেড়ে ওঠার পেছনে যে বিষয়টি কাজ করে তা হলো বন্ধন (Attachment)। বন্ধন বলতে বাবা মায়ের সঙ্গে শিশুর এক নিগুঢ় সম্পর্ককে বোঝায় যা জন্মের প্রারম্ভ থেকে শুরু করে দীর্ঘকাল পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। সাধারণত শিশুর সঙ্গে প্রত্যহিক কর্মকাণ্ড যেমন, খাবার খাওয়া, খেলাধূলা, কিংবা যিনি তার নিরাপত্তা দেন এমন ব্যক্তির সঙ্গেই বন্ধন বা এটাচমেন্ট তৈরি হয়। আর শিশুর সঙ্গে এ প্রাথমিক বন্ধন স্থাপনকারীকে অ্যাটাচমেন্ট ফিগার (Attachment Figure) বলা হয়। সাধারণত এক্ষেত্রে প্রথমেই থাকেন মা, পরবর্তিতে বাবা, ক্রমান্বয়ে দাদা, দাদি এবং অন্যরা। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর সঙ্গে রক্তের সম্পর্কে নেই এমন কেউ কিংবা যিনি মা নন তবে মায়ের মতন সান্নিধ্য দেন এমন যে কেউ অ্যাটাচমেন্ট ফিগার হতে পারেন।

সাধারণত অ্যাটাচমেন্ট ফিগারের অনুপস্থিতিতে বা তাদের প্রস্থানের সময় শিশুরা কিছু আচরণ করে থাকে যার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয় যে তাদের মধ্যে বন্ধন স্থাপিত হয়েছে। এধরণের আচরণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মা কক্ষ ত্যাগের সময় শিশুর কান্না, হামাগুড়ি বা হেঁটে মায়ের দিকে যাওয়া, চিৎকার করে ডাকা, জড়িয়ে ধরে থাকা, লাফ দিয়ে কোলে উঠে বসা, মায়ের অবজ্ঞায় রাগান্বিত হওয়া, অন্য সময়ের তুলনায় মায়ের উপস্থিতিতে সহজাত ভঙ্গিতে কথা বলা, খেলা করা , ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। সাধারণত শিশুর ৫ বছর বয়সের পর এ আচরণগুলো আর থাকেনা। ৫ বছরের পর এ আচরণগুলো থেকে গেলে শিশু মনস্ত‍াত্বিকগণ একে “সেপারেশন অ্যাংজাইটি”(Separation Anxiety)বলেন যা কোনো রোগ নয়।

অনেক ক্ষেত্রে স্কুলে ভর্তির পর শিশুদের এ আচরণগুলো আরো প্রকট হতে পারে। তবে সেপারেশন অ্যাংজাইটি দীর্ঘকাল স্থায়ী হলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই ভাবনার বিষয়। তখন তা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যাকে সেপারেশন অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার (Separation Anxiety Disorder ) বলা হয়। আবার শিশুদের অনেকসময় অপরিচিত জনের উপস্থিতিতে চিন্তিত বা ভীত হতে দেখা যায় যাকে স্ট্রেঞ্জার অ্যাংজাইটি (Stranger Anxiety) বলে।   শিশুর এ আচরণ একেবারেই সহজাত। শিশুর  ৯ মাস বয়স থেকে ২-৫ বছর পর্যন্ত এ আচরণ থাকা স্বাভাবিক। পরবর্তীতে এ ধরণের আচরণের স্থিতি সোশাল ফোবিয়ার জন্ম দেয়। যা তার ব্যক্তিত্বের ওপর তদুপরি সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ।

সার্বিক বিবেচনায় শিশুর সঙ্গে বাবা-মা কিংবা তাদের অনুপস্থিতিতে অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক দু’ধরণের হতে পারে। নিরাপদ এবং অনিরাপদ। নিরাপদ বন্ধন (Secure Attachment) শিশুকে উষ্ণতা, স্বস্তি ও নিরাপত্তা দেয়, শিশুও নিজেকে নিরাপদ ভাবে এবং  উ‍ৎসাহী মন নিয়ে স্বাধীনভাবে চারপাশ ঘুরে বেড়ায়, ক্রমান্বয়ে নানান বিষয় শিখতে থাকে। আবার ঠিক তার বিপরীত দিকে আছে অনিরাপদ বন্ধন বা Insecure Attachment। এ ক্ষেত্রে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তার মুক্তভাবে বিচরণ কিংবা শেখার আগ্রহ তেমন থাকেনা।   শিশু মনস্তত্ব এ অনিরাপদ বন্ধনের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। কেননা এ ধরণের সম্পর্ক শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পথ অনেকাংশে ব্যহত করে ।   বাবা মায়ের অবজ্ঞা অবহেলা, তাদের মধ্যকার সমস্যার টানাপোড়ন, মায়ের বিষাদ গ্রস্ততা, শিশু নিগ্রহ(মৌখিক/শারীরিক/মানসিক) ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।

আবার অতিমাত্রায় শিশুর প্রতি নমনীয়তা বা যত্নশীল আচরণের  নেতিবাচক দিকও রয়েছে। অর্থাৎ শিশুর প্রতি বাবা মায়ের আচরণ ভারসাম্যপূর্ণ হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সঠিক ও ত্রুটিপূর্ণ দু’ধরণের মনোভাব/আচরণ দেখা যায় (Healthy & Unhealthy Parental Attitude)। যা পরবর্তী লেখায় আলোচনা করা হবে।
অনেকে হয়তো শুনে অবাক হবেন, প্রাপ্তবয়স্কদের মতন শিশুরও দৈহিক বৃদ্ধির আড়ালে প্রতিদিন ধীরে ধীরে মনোজগৎ গড়ে উঠছে। আর সে মনোজাগতিক বৃদ্ধির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো সামাজিক বৃদ্ধি। সামাজিক উপাদান হিসেবে তার বৃদ্ধি ঘটতে থাকে নিজের বা সবার অলক্ষ্যেই। সে শব্দ , আলো, দৃশ্য, ঘটনা  ইত্যাদিকে তার মতো করে চিনতে শেখে ।   ভাবতে শেখে সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়েও।

শিশু শিখে নেয় কিভাবে অন্যদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে হয়। প্রতিদিন সে নানান আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধু কিংবা খেলার সাথীর সঙ্গেও পরিচিত হয়। শিশুর সামাজিক সত্তা হিসেবে বেড়ে ওঠা এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের এ সহজাত প্রক্রিয়াই হল সামাজিক বৃদ্ধি। কাজেই শিশুর এ সামাজিক স্বত্তা হিসেবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাবা মায়ের সাথে সন্তানের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সুস্থ বন্ধনই আগামী দিনে সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সুদৃঢ় সোপান রচনা করে। তাই প্রতিদিনের দমবন্ধ ব্যস্ততার ফাঁকে ক্ষণিকের জন্য ভাবুন “বাচ্চাটা কি আপনার যথেষ্ট আদর পাচ্ছে?”
 
ডা. মো. সালেহ উদ্দীন
এম  ডি , ফেইজ এ (সাইকিয়েট্রি)
ডিপার্টমেন্ট  অফ সাইকিয়েট্রি,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর  [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad