ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

দুর্যোগ ও মানুষ: মানসিক সমস্যার বিভিন্ন পর্যায় বা ধাপ

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৩
দুর্যোগ ও মানুষ: মানসিক সমস্যার বিভিন্ন পর্যায় বা ধাপ

মানুষ কখন কি ভাবছে, কেন ভাবছে অনেক সময় হয়তো সে নিজেও জানেনা। তবে মন কিভাবে চলবে তা অনেকটা নির্ভর করে সময় ও পরিপার্শ্বের ওপর।



আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে মন কি করবে তা বলা না গেলেও বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে মন কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, তার অনেক কিছুই আজ আর অজানা নয়, বিজ্ঞানের হাতের মুঠোয়।
শুধু দুর্যোগ নয়, যেকোনো বিপর্যয়েই মন যে ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে তার কিছু ব্যাখ্যা বিজ্ঞাসম্মসত ভাবে দেওয়া যেতে পারে।

সাধারণত দেখা যায় বড় কোনো দুর্যোগের পর মন বিভিন্ন ধরনের ধারাবাহিক প্রিতিক্রিয়ার ভিতর দিয়ে পার হয়।   সময় এবং বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় প্রতিক্রিয়াগুলির নিজস্ব কিছু সাতন্ত্র্য থাকলেও, এর ভেতরের আচরণগুলো বেশিরভাগ সময়েই একটি অপরটির সঙ্গে মিলে যায়।

বিপর্যয়ের পর মানসিক সমস্যার এ ধাপগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রথমত
দুর্ঘটনার পরই মন যা চায় বা যে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা হলো উদ্ধারের জন্য আকুলতা। এসময়ে মানসিক কিছু বিশেষ প্রতিক্রিয়া এবং আচরণও লক্ষ করা যায়। ইংরেজিতে  এ ধাপ বা পর্যায়কে বলা হয়ে থাকে-The ‘Rescue’ Stage.

দ্বিতীয় ধাপটিকে বলা হয়, The ‘Inventory’ Stage. এ পর্যায়টি সবচেয়ে খারাপ হতে পারে। এসময় দেখা যায়, বেঁচে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর মন হিসেব করতে বসে, কতটুকু ক্ষতি হলো, কি হলো, কিভাবে হলো, ভবিষ্যতে কি হবে ইত্যাদি। মনের ভেতরে সবচেয়ে তীব্র ও জটিলতম প্রতিক্রিয়া ও সমস্যাগুলো লক্ষ করা যায় এসময়। মানসিক বিভিন্ন সমস্যাও এ ধাপটিতে দেখা দিতে পারে।

তৃতীয় বা শেষ ধাপটি একটু অন্যরকম, দেখা যায় বিশেষ কিছু মানসিক সমস্যা নতুন করে আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ প্রথম দুটি পর্যায় বা স্টেজ পার হবার পরও যাদের কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দেয়নি তাদের মাঝেও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কিছু মানসিক রোগ দেখা দেয়। যে ধাপটিকে বর্ণনা করা হয়েছে The “Reconstruction” stage হিসেবে।

The “Rescue” Stage বা উদ্ধারের প্রাথমিক পর্যায়ে মানসিক প্রতিক্রিয়া:

আমরা জানি, দুর্যোগের পর প্রথম কাজটি হয় আক্রান্ত মানুষগুলোর বেঁচে থাকার ব্যবস্থাসহ সার্বিক পরিস্থিতিকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। সেসঙ্গে প্রয়োজনীয় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা, জাম-কাপড়, খাবার ও থাকার জায়গা ঠিক করাও জরুরি।

সেসময় আক্রান্ত মানুষগুলোও দিশেহারা হয়ে যায়, বিভিন্ন রকমের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াও তখন অসম্ভব নয়। এসময় সাধারণত যে সমস্যাগুলো দেখা য়ায তা হল-

Psychic ‘numbing’ বা মানসিক অসারতা: হঠাৎ করে ঘটা ঘটনার আকস্মিকতায় বেশির ভাগ মানুষই হতভম্ব হয়ে যায়। বিভ্রান্ত ও আক্রমনাত্বক হয়ে উঠতে পারে। অনেকে স্তব্ধ হয়ে যায়, কথা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে অসম্ভব উদ্বিগ্নতায় রূপ নেয়।
 
Heightened arousal বা অতিরিক্ত অস্থিরতা: মনের ভেতর অস্বাভাবিক মাত্রায় ভয় বাসা বাধে। এছাড়া দম বন্ধ ভাব, বুক ধরফর, শিরদ্বারাসহ সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে আসা, পাতলা পায়খানা কিংবা ঘন ঘন পস্রাবের চাপ। কাউকে আবার অস্বাভাবিক মাত্রায় অনর্থক ছুটাছুটি করতে দেখা যায়।

Diffuse anxiety বা উদ্বিগ্নতা: একটু স্থির হলেও উদ্বিগ্নতা যেন মনের ভেতর স্থায়ীভাবে বাসা বাধতে চায়। হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠা, স্থির বা কোনো ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, নিজেকে অকেজো মনে করাসহ আরও অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

Survivor guilt বা আত্ম অনুশোচনা: চারপাশের অনেক মানুষের মৃত্যু দেখে নিজের ভেতর এক ধরনের আত্ম অনুশোচনা দেখা যায়। মন বলে আমার হয়ত এ ব্যাপারে অনেক কিছু করার ছিলো। বা এ  ঘটনাটা হয়ত আমার জন্যই ঘটেছে। বিশেষ করে এটা যাদি কাছের মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে তাহলে আত্মঅনুশোচনার মাত্রাটাতো আরও বেশি হয়।

Conflicts over nurturance বা অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি: খাবার কিংবা থাকার জায়গা নিয়ে অনেক ব্যাপারেই অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা অনেকেই মেনে নিতে পারেননা। নিজেকে তখন অন্যের কাছ খেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চান। উল্টো চিত্রও দেখা যায়। অনেকে চান সবসময় কেউ না কেউ তার সঙ্গে থাকুক।

Ambivalence বা বিভ্রান্তি: ব্যক্তিগত, পারিবারিক কিংবা সামাজিক কোন বিষয়ে কি করবেন বা কি করা উচিত তা নিয়েও বিভ্রান্ত হয়ে পরেন অনেকে।

Affective and cognitive instability বা আবেগ ও বোধের সমস্যা: এসময় কেউ কেউ হঠাৎ রাগান্বিত বা ক্ষেপাটে হয়ে ওঠেন। কেউবা আবার সম্পূর্ণ চুপচাপ হয়ে যায়, যেন নড়তে চড়তে পারেন না। অনেকে সব কিছু ভুলে যান। কিছুই মনে করতে পারেনা এবং কারণে অকারণে কেঁদে ফেলেন। নিজেকে চরমতম অসহায় ভাবতে থাকেন।

acutely confusional state বা মানসিক উম্মাদনা: কারো কারো মাঝে ডিলুশন, হ্যালোসিনেশনসহ বিভিন্ন ধরনের অসংলগ্ন আচরণ দেখা যায়।

তবে এর বাইরেও অনেক মানুষ থাকেন যারা নিজেকে ঠাণ্ডা রেখে, পরিস্থিতি বুঝে, নিজের এবং কাছের কিংবা ভালোবাসার মানুষদের রক্ষা করতে প্রস্তুত থাকেন। নিজের জীবন বাজি রেখেও তখন অন্যকে সাহায্য করে থাকেন। বিজ্ঞান এ ধরনের মানসিকতাকে বলে ‘অলট্রিস্টিক বিহেভিয়ার’। অর্থাৎ অন্যের জন্য নিজেকে উজার করে দেওয়ার মানসিকতা বা আচরণ।

The “Inventory” Stage বা উপলব্দি পর্যায়:
তাৎক্ষণিক বিহ্বল-বেসামাল অবস্থা বা অনুভূতিকে অতিক্রম করে মানুষ যখন থিতু হতে থাকে, অনেক কিছুই মনে আসে তখন। ইচ্ছে অনিচ্ছেতে অনেক হিসেব নিকেস চলতে থাকে মনের খাতায়। নিজের হিসেব, অন্যের হিসেব, কাজের হিসেব, পরিবেশের হিসেব, ভবিষ্যতের হিসেব ইত্যাদি। কেউ কেউ হিসেবগুলো ভালো করে বুঝে নিয়ে নতুন করে শুরু করেন। কেউ আবার কূল পায়ননা, পাথার নামে চোখের পাতায়। মনের ভেতর হানা দেয় নতুন দুর্যোগ।

পরবর্তীতে (এক থেকে দেড় বছরে) যখন সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার হিসেবগুলোও শেষ হয়ে আসে, তখনই আসলে প্রকৃত বাস্তবতার মখোমুখি হতে হয়। ততদিনে কেউ সহ্য করার ক্ষমতা পেয়ে যান, কেউ সঞ্চিত শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেন। মাঝখানের সময়টির মানসিক অবস্থার কথাই বর্ণনা করা হবে, এপর্যায়ে। যে পর্যায়টির নাম হতে পারতো হিসেব-নিকেশ ও মানসিক অবস্থা।

ঘটে যাওয়া দুর্যোগের সপ্তাহ খানেক পর থেকেই আক্রান্ত মানুষকে যেতে হয়ে বিভিন্ন চড়াই উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে। আগেই উল্লেখ করা হয়েচে বেঁচে থাকার অনুভূতিটি মানুষকে তাৎক্ষণিক একধরনের রিলাক্স পর্যায়ে নিয়ে আসে। যার নাম দেওয়া হয়, ‘হানিমুন স্টেজ’।

নেকের জন্য, আপাত এ সুখানুভূতি মরিচীকার মতোও হতে পারে। উদ্ধার পাওয়ার সপ্তাহ খানেক পর থেকে সে অনুভূতি কমে আসতে থাকে। মানুষ তার সত্য অবস্থান ও বাস্তবতার অনুভূতিগুলো হিসেব করতে শুরু করে। শুরু হয়ে ভিন্ন এক কষ্টের জগৎ। যার নাম দেওয়া হয়, ‘সেকেন্ড ডিজাস্টার বা দ্বিতীয় দুর্যোগ’। আর এসময়েই মানুষগুলো বিভিন্ন মানসিক সমস্যা ও রোগে আক্রান্ত হয়। কেউ কেউ একাধিক মানসিক সমস্যায়ও ভুগতে পারেন।

মানসিক এসব সমস্যাকে একসঙ্গে ‘পোস্ট ট্রমাটিক সিন্ড্রম বা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারস’ বলে।

সেসময় আক্রান্ত হওয়া বিভিন্ন মানসিক রোগগুলো হচ্ছে, ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅডার’, ‘জেনারেলাইজড এনজাইটি ডিজঅর্ডার’, ‘অ্যাবনর্মাল বিরিভমেন্ট’, ‘পোস্ট ট্রমাটিক ডিপ্রেশান’, ‘পেনিক ডিজঅর্ডার’, ‘সোশাল ফবিয়া’, ‘স্পেসিফিক ফোবিয়া’ প্রভৃতি। উল্লেখিত নামগুলো পরিচিত না হলেও, মনে রাখতে হবে এসব সমস্যার প্রায় সবই ভয় এবং মনের ভেতর কষ্ট হওয়ার অনুভূতি নিয়ে আসে।

এসবের মধ্যে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ সবচেয়ে বে‍শি হয়, যে রোগটি একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর হতে পারে। বহুদিন পর্যন্ত যা বয়ে নিয়ে যেতে হতে পারে। এতে প্রধানত তিন ধরনের সমস্যা হয়।

১.    বার বার চোখের সামনে ঘটনাটি তার পূর্ণ রুপ নিয়ে ফিরে আসে। মনে হয় ঘটনাটি বারবার ঘটছে।
২.    সবসময় প্রচণ্ড উদ্বেগ ও উত্তেজনায় ভুগতে হয়। মনে সবসময় চরম অস্থিরতা কাজ করে।
৩.    ঘটনাটি মনে হতে পারে, এমন সব কিছুকে এড়িয়ে চলতে চায় এবং চলে।
সেসঙ্গে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত জীবনসহ সবখানে অচল অবস্থা চলতে থাকে।

‘জেনারেলাইজড এনজাইটি ডিজঅর্ডার’ এ দেখা যায় আক্রান্ত মানুষটি কারণে অকারণে উত্তেজনা ও উদ্বেগের ভেতর দিয়ে সময় পার করছে। স্থির থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া ‘এবনর্মাল বিরিভমেন্ট’-এ নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুতে কষ্ট পাওয়া, খারাপ লাগা এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা আবার অতি দ্রুত স্বভাবিকও হয়ে আসে কিন্তু এখানে দেখা যায়, কেউ হয়তো সেরকমক কষ্টের ভেতর দিয়ে তিন-চার মাস বা তারও বেশি সময় পার করছেন। কেউ হয়তো আবার সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছেন।
 
এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা, যা রোগের পর্যায়ে ধরা হয় না, এমন সমস্যা প্রায় সব মানুষের ভেতরই কিছু না কিছু দেখা যায়। সেসব সমস্যা হয়তো রোগের মতো মানুষের সবদিক আক্রান্ত করে না, কিন্তু কষ্ট দেয়। বিষন্নতা, হতাশা, মন খারাপ থাকা, অসহায় অনুভূতি, উদ্বিগ্নতা, নার্ভাসনেস, সহজে ক্ষেপে যাওয়া বা ভয় পাওয়া, চমকে ওঠা, ভুল ধারনা বা চিন্তা করা, সময়ে অসময়ে বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়া, জোর জবরদোস্তী করার প্রবণতা, বিনা প্রয়োজনে কঠোর আচরণ, নিজের সকীয়তা হারানো, পরনির্ভরতা,  বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছুকে আকড়ে ধরা, নিজেকে সমাজবিচ্ছিন্ন করে ফেলা, ঘরে বসে থাকার প্রবণতা, সন্দেহ প্রবন, অপ্রয়োজনীয় অস্থিরতা, ঘুমের সমস্যা, ইনসোমনিয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ক্ষেপাটে হয়ে যাওয়া, কোনো কিছুতেই মনোযোগ ধরে রাখতে না পারাসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। যেমন- মাথব্যথা, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাথা অনুভব, পেটের বিভিন্ন রকম সমস্যা, কারণে অকারণে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, শরীর বা হাত-পা বুক কাঁপা, অসম্ভব দুর্বল লাগাসহ নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা তৈরি হওয়া। মোটকথা একজন মানুষ  যদি তার মন ঠিক রাখতে না পারে, তবে তার যেকোনো জগৎ অর্থাৎ চিন্তা ও কাজের জগৎ সবখানে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

সাইকোলজিকাল সাপোর্ট বা মানসিক বিষয়গুলো এস্টেজে কিভাবে এবং কতটুকু যত্নসহকারে দেখভাল করা হয় তার উপর অনেককিছু নির্ভর করে। এই স্টেজটি তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময় আক্রান্ত মানুষগুলো মানসিক ব্যাপারে যদি প্রয়োজনীয় সহায়তা পায়, তবে এসব সমস্যার অনেক কিছুই মোকাবেলা করার যোগ্যতা তৈরি হয়। সমস্যায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও অনেক কমে যায়।

The “Reconstruction” stage বা পূনর্গঠন পর্যায়

পৃথিবীর বড় বড় দুর্যোগের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এক থেকে দেড় বছর সময়ের ভেতর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহায়তা দানকারী সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম কমিয়ে আনে  বা বন্ধ করে দেয়। তখন ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত মানুষের জন্য তা হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ ভিন্ন বা নতুন একটি অভিজ্ঞতা।

দুর্ঘটনা ঘটার পর আক্রান্ত মানুষের মাঝে যেসব মানসিক সমস্যা হয়, ইতোমধ্যে সেসবও অনেকাংশে কমতে শুরু করে। অনেকের মাঝে আবার সমস্যাগুলো থেকেও যায়। সমস্যার বিষয় হলো, এ পর্যায়ে  মানুষের ভেতর নতুন করে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যার অধিকাংশই থাকে ডিপ্রেশন ও এনজাইটি বিষয়ক। হারিয়ে  যাওয়া সময়, কাজ বা সম্পর্ক যেন নতুন করে মনে এসে ভর করে। এসময় অনেকের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দেয়।

দেরিতে দেখা দেওয়া অন্যান্য লক্ষনগুলো হল- সবসময় দুর্বল লাগা, পেটের বিভিন্ন রকম সমস্যা, কাজ করতে মন না চাওয়া, দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।

‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের’ ক্ষেত্রে একটি কথা আছে, যারা ঘটানাকে দেখে বা প্রত্যক্ষ করে তাদের মাঝেই এটা বেশি হয়। সেটা নিজের ওপর বা অন্যের ওপর ঘটা কোনো বিপদই হোক না কেন!

অনেকগুলো গবাষণার ফলাফল এটি প্রমাণ করেছে যে, যেসব ভুক্তভোগি  বারবার তীব্রতর আঘাতের আক্রান্ত হয়েছেন, যারা বারবার নির্যাতিত হয়েছেন কিংবা শারীরিক, মানসিক বা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের মাঝে এ পর্যায়ে এসে সমস্যা বেশি হয়। যারা করসেন্ট্রেশান ক্যাম্প বা যারা মাস বা বছর ব্যাপী যুদ্ধাক্রান্ত অবস্থায় পার করেছেন তাদের ভেতরও সমস্যা বেশি হয়।

‘সারভাইবারস্ সিন্ড্রম’ বলেও একটি কথা আছে। অর্থাৎ যারা এমনকোনো দুঃসহ অবস্থা থেকে বেঁচে এসেছেন, তাদের জীবন পার হয় কোনো আলো আচঁড় ছাড়াই। এই আলোহীন চালিত জীবনকেই বলে ‘সারভাইবারস্ সিন্ড্রম’।

তাদের ক্ষেত্রে ‘জয় অব লাইফ ইজ গন’ অর্থাৎ জীবনের সমস্ত আনন্দ নিভে গেছে। শুধু বিষাদময় জীবনটাকে টেনে নিয়ে বেড়াতে হয়। স্বামী স্ত্রী, সন্তানের সঙ্গেও আর স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় থাকেনা। এমনকি পরবর্তী জেনারেশনের সঙ্গেও তারা আর সহজ হতে পারেননা।

ভুতপূর্ব জীবনের অনেক আনন্দ তখন হয়ে যায় শুধু মাত্র স্মৃতি। অনেকে কিছু কিছু ‘কালচার বাউন্ড সিন্ড্রম’ এ ভুগতে থাকেন। যেসব সমস্যা শুধু তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভিতরই দেখা যায়। বিশেষ ধরনের সমস্যা যা সাধারণ ফরমুলায় বিচার করা যায়না। একমাত্র বিশেষজ্ঞরাই সেটিকে সনাক্ত ও দূর করতে পারেন।

পরবর্তী সংখ্যায় থাকবে সামাজিক জীবনে দুর্যোগের প্রভাব।

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৫ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।