ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

দুর্যোগ ও মানুষ: দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক সমস্যা

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪২ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৩
দুর্যোগ ও মানুষ: দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক সমস্যা

মানুষের জীবন-মন অদ্ভুত এক যাদুর জগৎ, বিস্ময়। সবসময় সঠিক নিয়মের ভেতর ফেলে, এর কাছ থেকে ঠিক ঠিক বিষয়গুলিকে আদায় করে নেওয়া সহজ নয়।



মন কখন কি চায় বা ভাবে বলা কঠিন, আর তা খোঁজার চেষ্টা করা আরও বিস্ময়কর, জটিল ও প্রায় অসম্ভব একটি অভিযান। তবু বিজ্ঞান, এর ভেতর থেকেই কিছু কিছু সম্ভাবনা ও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে আলাদা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই চেষ্টার আসল কারণ কিন্তু মানুষ। মানুষের বেঁচে থাকাকে সহায়তা করা। জীবনের পদক্ষেপগুলোকে সহজ করা। টিকে থাকাকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করা।

টিকে থাকতে গিয়ে মানুষকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় জীবনের সঙ্গে। জীব-জন্তু পোকা-মাকাড়, অসুখ-বিসুখ, ঝড়-ঝাপটা, দুর্যোগ-মাহমারী, প্রকৃতির খেয়াল-খুশি, এমনকি মানুষের নিজেদের তৈরি বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত ও ফাঁক-ফোঁকড়ের সঙ্গেও। এমন কোনোকিছুর আক্রমন যখন মানুষের সামনে এসে হাজির হয়েই যায়, মানুষকে সেসবের মোকাবেলা করতে হয়। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, করতেই হয়, বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য।

বিজ্ঞান বলে, এই টিকে থাকার সংগ্রামে সবাই সমান পারদর্শী হবে এমন কোনো কথা নেই। উল্টোভাবে এটাও বলা যায়, এসব আক্রমণে সবাই সমভাবে আক্রান্ত হবে তারও কোনো মানে নেই। অনাকাঙ্ক্ষিত, অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া বড় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও এমনই হয়। আর যেসব বিষয় মানুষের মানসিক দিকগুলোর বেশি ক্ষতি করে বা করতে পারে সেসব ক্ষেত্রে লক্ষ রাখলে সমস্যা মোকাবেলা করতে সহজ হয়।

দুর্যোগে মানসিক পরিবর্তগুলো সাধারণত নির্ভর করে-

১.    অতি সাধারণ বিশ্বাসের মতো বিজ্ঞানও এটির প্রমাণ পেয়েছে যে, দুর্যোগের ভয়াবহতা যত বেশি হবে, সরাসরি আক্রান্ত বা পর্যবেক্ষণকারী মানুষের ভেতর দুর্যোগ পরবর্তী মানসিক সমস্যার স্থায়িত্ব, ব্যাপ্তি ও তীব্রতাও তত বেশি হবে।

এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় দেখা যায়। যেখানে বেশি মানুষ সমানভাবে আক্রান্ত হয়, সেসব ক্ষেত্রে সমস্যাও বেশি হয়। অর্থাৎ কোনো ঘটনায় যদি স্বল্প সংখ্যক মানুষ অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা থেকে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দুর্যোগে আক্রান্ত হলে সেখানে মানসিক প্রভাব বেশি পড়ে। যেমন, ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের প্রভাব অনেক দিন পর্যন্ত থেকে যায়।

২.    যেসব দুর্ঘটনা ইচ্ছে করে ঘটানো হয়, সেসব ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা ও সমস্যার তীব্রতা বেশি হয়। যেমন- যুদ্ধ, সন্ত্রাসী আক্রমণ বা এমন কিছু। অন্যদিকে যেসব ঘটনা অনিচ্ছাকৃত কারণে ঘটে যায়, সেসব ঘটনায় আক্রান্ত মানুষের মানসিক সমস্যা তুলনামূলক ভাবে কম হয়। যেমন- বিমান দুর্ঘটনা, পরিবহনের অন্য কোনো বড় দুর্ঘটনা, শিল্প কারখানায় ঘটে যাওয়া কোনো অনাকাঙ্খিত বিস্ফোরণ প্রভৃতি। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ( ঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো) যে পরিমানে মানসিক সমস্যা হয়, উপরের যেকোনো ঘটনায় তার থেকে বেশি সমস্যা দেখা যায়।

তবে এসব ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যার ধরণ অনেকাংশে নির্ভর করে মানুষের মেনে নেওয়ার ক্ষমতা, অভ্যস্ততার ওপর।

৩.    মহিলা, বিশেষ করে যাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে থাকে, তাদের মানসিক সমস্যা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সন্তানের মৃত্যু কারো কাম্য নয়, কিন্তু তবুও কখনো কখনো এ বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় মায়েরাই মানসিক ভাবে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

৪.    যাদের পূর্ব থেকেই কোনো মানসিক সমস্যার ইতিহাস আছে, বা সম্ভাবনা থাকে তাদেরও নতুন করে সমস্যা বাড়তে পারে বা হতে পারে। পূর্বে থেকে মানসিক চাপে থাকা বা রোগাক্রান্ত মানুষটির মানসিক অবস্থা এমনিতেই নাজুক থাকে, তার উপর খাড়ার ঘা এর মতো এসব দুর্যোগ চেপে বসে মানুষটিকে বিক্ষিপ্ত করে তোলে।

৫.    আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই তার ভয়। কথার উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক সত্যতায় সর্বত্র সমান। এখানেও বিষয়টি সেরকমই ঘটে, অর্থাৎ যেসব মানুষ পূর্বে ব্যক্তিগত ভাবে (ধর্ষণ বা এক্সিডেন্ট) কিংবা সমষ্টিগত ভাবে  (ভূমিকম্প বা গণহত্যা) কোনো দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে, তাদের মানসিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

৬.    কিছু কিছু বিশেষ অভিজ্ঞতাও মানসিকভাবে বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন কাছের কাউকে মারা যেতে দেখা, কিশোর বয়সের সন্তানকে হারানো, গুলি বা বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতা, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আটকে যাওয়া এবং আপাতভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা, দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে আহত হওয়া ইত্যাদি। যার প্রায় অনেকগুলোই সাভার ট্র্যাজেডিতে আমরা দেখেছি।

আক্রান্তরা কাছ থেকে অনেককেই মারা যেতে দেখেছেন, বিশেষ করে আটকে থাকা অবস্থায়তো অবশ্যই। আমরা দেখেছি, অনেকেই বেঁচে এসেছেন, যাদের অনেকেই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষাও করেছেন, শুধু ভাগ্য বা কপালের জোড়ে এবং  উদ্ধারকর্মীদের সহায়তায় বেঁচে এসেছেন।

৭.    মনে রাখতে হবে, দুর্ঘটনায় আক্রান্ত মানুষের শারীরিক সমস্যাও পরবর্তীতে মানসিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেমন- শরীরের কোথাও পুড়ে যাওয়া, ছিড়ে যাওয়া, মাথায় আঘাত পাওয়া, শরীর বিষাক্ত কিছুর সংস্পর্শে আসা বা শরীরে অন্য কোনোভাবে বিষক্রিয়া তৈরি হওয়া ইত্যাদি। এসব সমস্যা পরবর্তীতে কাজের ক্ষেত্রে, চিন্তা করার ক্ষেত্রে, মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে বারবার অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে যাওয়াসহ আরও অনেক ধনের মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

৮.    যুদ্ধের কারণে বা রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বিভিন্ন শরনার্থীর মাঝেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সরাসরি ঘটনা ছাড়াও নিজের বাড়ি ছেড়ে আসা, শরণার্থী শিবিরে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাবের কারণেও মানসিক সমস্যা হতে পারে। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে এসব দেখা যায়। পুষ্টিহীনতা, বিভিন্ন ধরনের সংক্রমন বা সংক্রমিত রোগ, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতনসহ অনেক কিছুই মানুষের সমস্যা কিংবা রোগ তৈরি করতে পারে।

৯.    ধর্ষণের মতো অনেক বিষয় আছে, যেসব বিষয়ে মানুষ মুখ খুলতে চায় না। এখানে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার-কুসংস্কার বা সামাজিক ভাবে অপদস্ত হওয়ার ভয় কাজ করে। এসব ক্ষেত্রে সে হয়ত তার কথাগুলো, তার ভয়গুলো কারও সঙ্গে ভাগ করতে পারে না ফলে তার মধ্যে এক ধরনের মাসসিক চাপ কাজ করে। এসবও সমস্যা পরবর্তীতে মানসিক রোগসহ অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে। সুতরাং এ বিষয়ে সচেতনতা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ কায়দায় সহায়তা অতি জরুরি।

১০.    অন্যদিকে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা মনে রাখা জরুরি, তা হলো সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক সহযোগীতা, বন্ধু-বান্ধবদের সহযোগী মনোভাব মানসিক সমস্যা মোকাবেলা ও কমিয়ে আনতে দারুনভাবে সহায়তা করে। সন্দেহ নেই আমাদের দেশ-সমাজ এসব বিষয়ে পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে এগিয়ে, যা ধরে রাখাও জরুরি।

১১.    যাদের পূর্বে এধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং যারা সাফল্যের সঙ্গে এগুলো মোকাবেলা করেছেন তাদের জন্য বিষয়গুলো তুলনামূলক সহজ। পূর্বের অভিজ্ঞতা অনেক সময় ‘ভেকসিন’র মতো কাজ করে। আমাদের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার মানুষ অনেক সাহসী হয়। বারবার আক্রান্ত হওয়ার কারণে একধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয় যা মানুষকে আরো দৃঢ় ও শক্তভাবে মোকাবেলা করতে সহায়তা করে।

১২.    মনে রাখতে হবে, দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার তীব্রতা যত বেশি হয় ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর গুরুত্ব তত কমে আসে। দেখা যায় সবার মাঝেই তখন বিভিন্ন রকম মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তীব্রতা কম হলে, আলাদা মানুষের ভেতর আলাদা প্রতিক্রিয়া পাওয়া যেতে পারে।

১৩.    মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা ও প্রচার কৌশলও একটি বড় ব্যাপার। কিভাবে বিষয়গুলো মানুষ দেখছে, কতটুকু দেখছে, সেসব আবার মানুষ কিভাবে নিচ্ছে তাও একটি বড় ব্যাপার। পৃথিবীর অনেক দেশ শিশুদের এসব প্রচার থেকে দূরে রাখার সব রকম চেষ্টা করে থাকে।

দুর্যোগের পর আক্রান্ত মানুষগুলোর মনের ভেতর যে ভীষণ আলোড়ন তৈরি হয়, উপরের বিষয়গুলোর ওপর সেসবের অনেক কিছুই নির্ভর করে। যেকোনো ধরনের পদক্ষেপের জন্য বিষয়গুলোর গুরুত্ব অনেক। এসব মনে রাখলে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।

এর পরের সংখ্যায় থাকবে, দুর্যোগের কারণে মানসিক সমস্যার বিভিন্ন পর্যায় বা ধাপ

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad