ঘুম শব্দটি শুনলেই মনে বয়ে যায় এক ধরনের প্রশান্তি আর আরামের অনুভূতি।
ঘুম এমন একটি বিষয় যা সুস্থ কিংবা অসুস্থ দুই ধরনের মানুষের জন্যই সমান জরুরি।
দিনের ক্লান্তি ধুয়ে-মুছে নতুন শুরুর প্রেরণা জোগায় ঘুম। বিজ্ঞানও বলে, শরীরের সব তন্ত্র-মন্ত্রকে নতুন করে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে ঘুম। ব্যাটারি রিচার্জের মতোই পুনর্জাগরিত হয় শরীর-মন। সেই ঘুমে যদি কোনো কারণে বিঘ্ন ঘটে তাহলে কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব।
গত লেখায় আমরা জেনেছি ঘুম কখন এবং কীভাবে সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। আর এবারের লেখায় আমরা জানব ঘুমের এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ কী। কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখলেই আমরা এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি। জীবন ও মনকে ভরিয়ে দিতে পারি প্রশান্তি আর প্রফুল্লতায়।
ঘুম সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কিছু আচরণের পরিবর্তন বা অন্য কোনো কারণে ঘুমের সমস্যা ঘটলে সঠিক চিকিৎসাই পারে ঘুম না আসা সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে।
ঘুম সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আচরণের পরিবর্তন
ঘুমের সময় হিসাব করা:
ব্যক্তিগত আচরণে বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, নিজের ঘুমের ছন্দকে ঠিক করা। তার আগে আরও একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে, তা হলো- কতটুকু ঘুমে আমি সম্পূর্ণ ফ্রেশ ও সতেজ অনুভব করি তা বের করা। যেমন- কেউ যদি জানে আমার ৮ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন, তবে হিসাব করতে সহজ হবে পরদিন কাজে যেতে হলে কয়টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে। তার উপর নির্ভর করে ঠিক কখন ঘুমোতে যেতে হবে সেটাও ঠিক করা এবং ব্যক্তিগত আচরণে কিছু পরিবর্তন আনা। কিন্তু যদি নিজের হিসাব না থাকে তবে কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।
ব্যক্তিগত আচরণে পরিবর্তন আনা:
ব্যক্তিগত আচরণে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে যা ঘুমের ছন্দকে ঠিক করতে সাহায্য করবে। যেমন-
১. ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার নির্দিষ্ট সময় ঠিক করা (যা নিজের জন্য হিসাব করে বের করে নিতে হবে), যা স্বাভাবিক ঘুমের ছন্দকে ঠিক করতে সাহায্য করবে। কাজের সময় ফ্রেশ থাকা যাবে।
২. দিনের বেলা না ঘুমানো।
খুব প্রয়োজনে দুপুরের পর ৩০মিনিট থেকে ৪০মিনিট ঘুমানো যায়, তবে এর চেয়ে বেশি নয়। খেয়াল রাখতে হবে রাতের ঘুম যাতে নষ্ট না হয়।
৩. যে কোনো ধরনের উত্তেজক বা নেশা- চা, কফি ঘুমাতে যাবার কমপক্ষে তিন ঘণ্টা আগে থেকে বন্ধ রাখা। এমনকি ঝাল জাতীয় খাবার রাতের বেলা না খাওয়া।
৪. হালকা ব্যায়াম ঘুমের গভীরতা আনতে সাহায্য করে। তবে তা ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে দু’ঘণ্টা আগে শেষ করতে হবে।
ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চত করা:
১. নিজের জন্য আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা করা।
২. ঘুমের জন্য দরকারি তাপমাত্রা, শব্দ এবং আলোর কথা মনে রাখতে হবে। খুব বেশি ঠাণ্ডা-গরম, শব্দ বা আলো ঘুমের সমস্যা করতে পারে।
৩. শোবার ঘরে প্রয়োজনীয় বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা।
৪. শোবার ঘরের বিছানা শুধুই ঘুমের জন্য। বিছানায় শুয়ে টিভি দেখা, গল্প করা, পড়া ঠিক নয়।
৫. শোবার ঘরে টিভি বা কম্পিউটার না রাখাই ভালো। যদি থাকে তবে অবশ্যই বন্ধ করে বিছানায় যেতে হবে।
ঘুমানোর ঠিক পুর্ব মুহূর্তের প্রস্তুতি:
১. কাজের চিন্তা, দুঃখ-বেদনা কোনোভাবেই যেন বিছানায় আপনার সঙ্গী না হয়। চিন্তামুক্ত হয়ে ঘুমোতে যাওয়ার অভ্যাস করা।
২. প্রতিদিন বিছানায় যাবার আগে নির্দিষ্ট একটি কাজ করতে পারেন। যা অবচেতন মন আপনার ঘুমের কথা মনে করিয়ে দিবে। হতে পারে-একটু বই পড়া কিংবা হাত মুখ ধোয়া।
৩. নিজের সবচেয়ে আরামদায়ক পজিশনে শোয়াটাও অনেক জরুরি।
৪. ঘুমাতে যাবার ঠিক আগে টিভি দেখা বরং ঘুমকে দূরে সরিয়ে দিতে সাহায্য করে।
৫. ঘুমের আগে অনেকেই হালকা মিউজিক পছন্দ করেন। অনেক ক্ষেত্রে মিউজিক রিলাক্সেশনের কাজও করে, তবে তা সবার জন্য নয়।
ঘুম ভেঙে গেলে বা আসতে দেরি হলে করণীয়:
বিছানায় শুয়ে থেকে ঘুম আনার চেষ্টা করা বোকামি। বরং উঠে পড়ুন। সম্ভব হলে অন্য রুমে যান। হালকা কিছু কাজ করতে পারেন। তবে গভীর মনোযোগ দিতে হয় এমন কাজ না করাই ভালো। যেমন, অফিসের কাজ বা ঘরের প্রয়োজনীয় কাজ এসব না করাই ভালো। টিভি দেখাও ঠিক হবে না। ঘুম ঘুম লাগলে তখনই শুয়ে পড়ুন।
অনিচ্ছা সত্ত্বে ঘুমের সমস্যায় করণীয়:
হঠাৎ করে জায়গার পরিবর্তন, দেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে সময়ের পরিবর্তন। দিনে বা রাতে বিভিন্ন সময়ে কাজের সময় পরিবর্তন হওয়া। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করার জন্য অপেক্ষা করা।
ঘুমের সমস্যা ও বিভিন্ন রকম অসুস্থতা:
আগেই বলা হয়েছে, ঘুমের সমস্যার প্রধান কারণ মানসিক। শরীরের বিভিন্ন রোগও ঘুমের সমস্যা করতে পারে।
চিকিৎসা:
ঘুমের চিকিৎসার বেশিরভাগই নির্ভর করে পিছনের কার্যকারণের উপর। অর্থাৎ কোনো মনসিক চাপ থাকলে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হবে বা সমস্যাটি সমাধান করতে হবে। অন্য কোনো রোগের কারণে সমস্যা হয়ে থাকলে সেটির প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘুম সংক্রান্ত একটি প্রাসঙ্গিক গল্প বলা প্রয়োজন।
প্রায়ই আমরা রোগির কাছ থেকে বা তার আত্মীয়ের কাছ থেকে শুনে থাকি ‘ওর বা আমার ঘুমের সমস্যা’। তারপর নানা প্রশ্ন এবং উত্তরের মাধ্যমে বের হয়ে আসে তার মূল সমস্যাটি। ধরা যাক সমস্যাটি ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রশ্ন বা মতামত শেষ পর্যন্ত থাকে, ঘুমের সমস্যা ঠিক হলে বা ঠিক মতো ঘুম হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
এখানে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যদি ঘুমের ছন্দটি নষ্ট হবার কারণে এ ডিপ্রেশন হয় তবে ঘুম ঠিক হলে সব ঠিক হবে। যদি তা না হয় তাহলে যে মানসিক সমস্যার জন্য ঘুমের সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা ঠিক হলেই কেবল ঘুমের সমস্যা ঠিক হবে। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় এবং সঠিক চিকিৎসাই ঘুমকে ঠিক করতে সাহায্য করবে।
তাই ডিপ্রেশন, এনজাইটিসহ যে কোনো ধরনের মানসিক রোগ বা শারীরিক রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি।
‘স্লিপ হাইজিন’ বলতে একটি বিষয় আছে যা যে কোনো রকম ঘুমের সমস্যার জন্য কার্যকর। ‘স্লিপ হাইজিন’ হলো কিছু নিয়ম কানুন ও আচার আচরণ, যা ঘুমকে স্বচ্ছন্দ ও স্বাভাবিক রাখতে এবং স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে (উপরে বেশির ভাগই বর্ণনা করা হয়েছে)।
ওষুধের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ঘুমের অনেক ওষুধ ডিপেন্ডেন্সি বা নেশার মতো অবস্থা তৈরি করতে পারে। যা থেকে আবার নতুন করে ডিপ্রেশন, যৌন সমস্যাসহ নতুন সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই সাবধানে এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা সহকারে ঘুমের ওষুধ খেতে হবে।
ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৩
সম্পাদনা: মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর