ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

ঘুমের কথা: ঘুম যখন সমস্যা

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৩
ঘুমের কথা: ঘুম যখন সমস্যা

সকাল থেকেই শরীরটা ভালো লাগছে না, ম্যাজম্যাজ করছে। কোনো কাজেই ঠিকঠাক মন বসছে না, দ্রুত ক্লান্তি আসছে।

একটু যেন বিশ্রাম নিতে পারলে ভালো হতো।

এই অনুভূতিগুলো আমাদের খুব অপরিচিত নয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সপ্তাহ, মাসব্যাপী চলতে পারে এমন অস্বস্তি। একপর্যায়ে সেখান থেকে আসে হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি।

অনেকেই একে বড় কোনো অসুখ ভেবে ভুল করেন, ছুটে যান চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু আপনার দৈনন্দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের মধ্যেই হয়তো রয়েছে এর মহৌষধ, যা উপলদ্ধি করতে পারছেন না। এই মহৌষধের নাম- ‘ঘুম’।

ভেবে দেখুন তো, এই যে মানসিক অস্বস্তি, ক্লান্তি, অবসাদ ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল? যেদিন থেকে ঘুম কমিয়ে দিয়েছেন, কিংবা অপরিমিতভাবে ঘুমাচ্ছেন সেদিন থেকে কী?  

ঘুম মানে শান্তি, ঘুম মানে অবসন্নতার শেষ বিন্দু, আবার ঘুম মানে পরিপূর্ণতা।

ঘুম এমন একটি বিষয় যা সুস্থ কিংবা অসুস্থ দুই ধরনের মানুষের জন্যই সমান জরুরি। দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য একটি বিষয়। ঘুমের সমস্যার নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে বের করে, তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা যেমন জরুরি। তেমনই জরুরি একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক ঘুমের মাত্রা, পরিমান ও পরিবেশ নিশ্চিত করা।

ঘুম শব্দটি শুনলেই যেন মনে একটা প্রশান্তি আর আরামের অনুভূতি বয়ে যায়।

দিনের ক্লান্তি ধুয়ে-মুছে নতুন একটা শুরুর প্রেরণা জাগায় ঘুম। বিজ্ঞানও বলে, শরীরের সব তন্ত্র-মন্ত্রকে নতুন করে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে ঘুম। ব্যাটারি রিচার্জের মতই পূনর্জাগরীত হয় শরীর-মন। সেই ঘুমে যদি কোনো কারণে বিঘ্ন ঘটে তাহলে কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা সম্ভব।

ঘুম কি?
ঘুমে বিঘ্নতা ঘটলে কী হতে পারে তা জানার আগে বা ঘুমের সমস্যা বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার আগে, ঘুম বিষয়টি আসলে কী তা জেনে রাখলে সুবিধা হতে পারে।

ঘুম মূলত একটি মনোজৈবিক চাহিদা, যা শরীরের ভেতরের বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অনেকে মনোবিজ্ঞানী অনেকভাবে ঘুমকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কেউ চিকিৎসাবিজ্ঞানের দিক থেকে, কেউ মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে, কেউ আবার শুধুই দৈনন্দিন কাজের অংশ হিসেবেই একে ব্যাখ্যা করেছেন।

ঘুমের চরিত্রগত দিকটি কম বেশি আমরা প্রায় সবাই জানি। যেমন- তখন মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতি কমে আসে, শরীর প্রায় অসাড় হয়ে যায়, বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া-বিক্রিয়ার গতি কমে আসে, তাপমাত্রা কমে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ হয়ে আসে।

অপরিপূর্ণ ঘুমের ফল
অপরিপূর্ণ ঘুমের ফলে সারাদিন কাটতে পারে অলসভাবে। ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে যেতে থাকে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ। কমে আসে কর্মক্ষমতা। প্রতিনিয়ত কম ঘুমের কারণে অবনতি হয় মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কের। ক্ষীণ হয়ে আসে আত্মনিয়ন্ত্রণ। অনুভূতিগুলোও যেন ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে। অবসাদ আর ক্লান্তি আচ্ছন্ন করে রাখে সমস্ত কাজ চিন্তা ও আচরণ। এরপর সব কিছুতেই সহজে আত্মসমর্পণ।

কেন এমন হয়?
ঘুমের সমস্যার প্রধান কারণ মানসিক। মনের ভেতর বাসা বাঁধে প্রাত্যহিক জীবনের কোনো সমস্যা (যেমন- ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক বা অর্থনৈতিক বিষয়) কিংবা নির্দিষ্ট কোনো মানসিক রোগ। সমস্যা যা-ই হোক না কেন, মনের সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক ওতপ্রোত।

মানসিক রোগের মধ্যে ডিপ্রেশন (হতাশা), এনজাইটি (ভীতি), ওসিডি (শুচিবায়ু), বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, যৌনরোগ বা যৌনসমস্যা এমনকি সেটা সিজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক সমস্যার কারণেও ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে থাকে। বিভিন্ন রকম নেশাও এর মধ্যে পড়ে।

তবে শারীরিক কারণেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। বিশেষ করে, যেসব রোগ দীর্ঘদিন যাবৎ চলে সেসব রোগের কারণে। ‘স্লিপ এপনিয়া’ নামে একটি সমস্যা আছে, যা ঘুমের তীব্র সঙ্কট তৈরি করতে পারে। কোনো কোনো ওষুধও ঘুম নষ্ট করতে পারে। তবে সবসময় যে ঘুমের সমস্যার কারণ বের করা যাবে, এমন কোনো কথা নেই। অর্থাৎ ঘুমের সমস্যার কিছু কারণ অনেকসময় সঠিকভাবে শনাক্ত না-ও করা যেতে পারে।

মানুষের স্বাভাবিক ঘুম কতটুকু?
যতটুকু ঘুম একজন মানুষের মন-শরীরের স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যকে ফিরিয়ে আনে, ততটুকু ঘুমই স্বাভাবিক। একেক জনের ক্ষেত্রে সেটা একেক রকম। সাধারণত সেটা ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা হতে পারে। তবে সেটা নির্দিষ্ট হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘক্ষণ ঘুমহীন একজন মানুষের কার্যক্ষমতা না-ও কমতে পারে। স্নায়ু সচেতন থাকতে পারে অন্যান্য সময়ের মতোই।

ঘুম কখন সমস্যা?
স্বাভাবিক ঘুমের ক্ষেত্রে সাধারণত শরীর একটি নির্দিষ্ট ছন্দ অনুসরণ করে। অভ্যস্ত সেই ছন্দের উপর ভরসা করেই ঘুম আসে এবং যায়। সমস্যার ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রথমেই স্বাভাবিক ঘুমের সেই ছন্দটি নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে ঘুম আসতে দেরি হয় বা অনেক সময় ঘুমই আসে না। ঘুমের স্থায়ীত্ব নষ্ট হয়ে যায়, অর্থাৎ কিছুক্ষণ পর পর ঘুম ভেঙে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ঘুম একবার ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না। মোট কথা, ঘুমের পরিমাণ ও উপযোগ্যতা (কোয়ালিটি এবং কোয়ানটিটি) দুটোই নষ্ট হয়।

কমপক্ষে দু’সপ্তাহ যদি এমন সমস্যা চলতে থাকে, তবেই সেটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে যাকে বলা হয় ‘ইনসোমনিয়া’।

ঘুমের আরো অনেক রকম সমস্যা থাকলেও ইনসোমনিয়াই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই ইনসোমনিয়া কোনো না কোনো মানসিক রোগের সঙ্গে সহরোগ হিসেবে থাকে। অবশ্য আলাদাভাবে কিংবা। শারীরিক রোগের সহযোগী হিসেবেও থাকতে পারে।

এছাড়া ঘুমের সমস্যা যে কোনো বয়সেই হতে পারে, তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে বেশি হয়।

ঘুমের সাধারণ সমস্যার ধরন
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ, যার সরাসরি মানসিক বা শারীরিক কোনো রোগ নেই, তার ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যার তিন ধরনের কারণ থাকতে পারে

১.    ঘুম নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
২.    স্বাভাবিক ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু আচরণের পরিবর্তন এবং
৩.    অনিচ্ছা সত্ত্বেও, বাধ্য হয়ে ঘুমের পরিপন্থি অবস্থার ভেতর দিয়ে যাওয়া।

ঘুম নিয়ে ভুল ধারণা ও ব্যাখ্যা
ঘুম নিয়ে বিভিন্ন ভুল ধারণা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের নিজস্ব ঘুমের চক্রটিকে ভেঙে দেয়। ফলে ব্যতিক্রম আরেকটি চক্র তৈরি হয়, যা মানুষের স্বাভাবিক ঘুমে সমস্যা করে। নিচে কিছু ভুল ধারণা ও সম্ভাব্য ফলাফল এবং এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় কিছু পরামর্শ দেওয়া হলো।

১.    ভুল ধারণা: অনেকে মনে করেন, রাতে ঘুম না হলে দিনে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেব।
    
এ চিন্তাটি কোনো ভাবেই স্বাভাবিক ঘুমের ছন্দকে সাহায্য করেনা। বরং ধীরে ধীরে ঘুমের আচরণ সম্পূর্ণ বদলে যায়। সুতরাং ঘুমের জন্য রাতকে (বা নিজের জন্য নির্ধারিত সময়কে) বেছে নেওয়া জরুরি ।

২.    ভুল ধারণা: আমি আমার স্বাভাবিক ঘুমের ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছি।
    
এটিও একটি ভুল ধারণা। মানুষের ঘুমের ক্ষমতা কখনোই হারাতে পারেনা। বরং ঘুম সংক্রান্ত আচরণের কোনো পরিবর্তনের জন্যই এটা হয়ে থাকে। সেটি খুঁজে বের করে ঠিক করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে।

৩.    ভুল ধারণা: বয়স হলে ঘুমের সমস্যা হবেই।

এ ধারণাও সঠিক নয়। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বয়সের সাথে সাথে ঘুমের সময় পরিবর্তিত হয়। মানুষ তখন তুলনামূলকভাবে আগে ঘুমাতে যায় ও আগে ওঠে। তবে তাতে সমস্যা নেই। সমস্যা হয় সেই সময়কে যখন পরিবর্তন করা হয়।

৪.    ভুল ধারণা: অনেকেই ভাবেন, আমাকে ৭/৮ ঘণ্টা ঘুমাতেই হবে।

    এ ধারণা ঠিক নয়। একেক জনের ঘুমের প্রয়োজন এবং ধরন একেক রকম।

৫.    ভুল ধারণা: আমার ঘুম ‘তার’ মতো হওয়া উচিৎ অর্থাৎ অন্যের সঙ্গে নিজের ঘুমের তুলনা করা।

    অনেকের ঘুম হালকা হয়, অনেকের গাঢ় হয়। কেউ শুয়েই ঘুমিয়ে পরে, কারও সময় লাগে। এটি প্রত্যেকের ঘুমের ধরনের উপর নির্ভর করে। অন্যের সঙ্গে ঘুমের আচরণ নিয়ে কখনোই তুলনা করা উচিত নয়। যেমন খাবার নিয়েও তুলনা করা উচিত নায়। যার যতটুকুতে পেট ভরবে, তিনি ততটুকুই খাবেন।

৬.    ভুল ধারণা: আমি ঘুমাতে পারছি না, সুতুরাং আমাকে আরও চেষ্টা করতে হবে।

    ঘুম একটি আরাম ও রিলাক্সের বিষয়। জোর করে ঘুমাতে যাওয়া মানে চিন্তাকে আরও সচল করা, যা ঘুম আসার পরিপন্থি। সুতরাং চিন্তা মুক্ত ও রিলাক্স থাকা প্রয়োজন সঠিক ঘুমের জন্য। প্রয়োজনে ‘রিলাক্সেশান’ শিখে নিতে হবে।

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘন্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৩
সম্পাদনা: হাসান শাহরিয়ার হৃদয় ও মীর সানজিদা আলম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।