ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

মনোকথা

মানসিক রোগ ও দৃষ্টিভঙ্গি

ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৩

‘মনোরোগ’ বা ’মানসিক রোগ’ শব্দগুলোর প্রতি আমাদের সাধারণ প্রতিক্রিয়া কি?
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে প্রতিক্রিয়াগুলি হয়ে থাকে সাধারণত দুধরণের। প্রথমত মানসিক রোগ ও রোগাক্রান্ত মানুষটির প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, দ্বিতীয়ত মানসিক রোগ বিষয়ে উদাসীনতা।



নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বলার কারণ এই যে, কারো মানসিক রোগ হয়েছে বা হতে পারে এ সত্যটি যেন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত যদি রোগটিকে মেনে নিতেই হয়, তবে সেই রোগীটির প্রতি বা রোগাক্রান্ত মানুষটির প্রতি তখন আর স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। অর্থাৎ রোগটির উপস্থিতি কোনো রকমে মেনে নিলেও রোগাক্রান্ত মানুষটিকে তখন মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে আশপাশের অনেকের মাঝেই এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষটির ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক দোষ- ত্রুটির সাথেও রোগটিকে মিলিয়ে ফেলা হয়। এটি যে একটি রোগ এই বিশ্বাসটুকুও যেন কোথাও হারিয়ে যায়।

অন্যভাগে যে উদাসীনতার কথা বলা হচ্ছে সেখানে দেখা যায়, মানসিক রোগের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন! বিষয়টি এরকম যে, ‘মানসিক রোগ আবার কি! মনটাকে একটু শক্ত করলেই তো সব ঠিক হয়ে যায়। আজেবাজে চিন্তা বা কাজ না করলেই তো হয়। মনের মধ্যে আবার রোগ কিসের?’

এমন সব মন্তব্য মনোরোগ চিকিৎসকদেরও মাঝেমধ্যে শুনতে হয়। যেহেতু মানসিক রোগকে রোগ হিসাবে দেখা হয় না, সেহেতু রোগাক্রান্ত মানুষটির উদ্দেশ্যে শুরু হয় বিভিন্ন রকমের পরামর্শ বা উপদেশ-- এটা এভাবে করো, এভাবে ভাবো, এটা করবে না, এটা কেন করো, কথা শোন না কেন, বোঝো না কেন? এমনি হাজার রকমের উপদেশ, পরামর্শ, শাসন এবং শেষ পর্যন্ত বকাবকি বা গালাগালি। যেন তাকে বুঝিয়ে বললে বা বকা দিলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

দুঃখজনক হলো, লোকটি অসামঞ্জস্য বা অগ্রহণযোগ্য আচরণ বা চিন্তা কেন করছে সেটি না বোঝার চেষ্টা করে উল্টো তাকে গালাগাল দেওয়া হয়। কিন্তু গালাগাল আর বকাবকি করলেই কী রোগ ভালো হয়ে যাবে!

আমাদের ভেতর এ বোধ জাগানো দরকার যে, রোগতো রোগই, এর দরকার চিকিৎসা। আমাদের মনে রাখতে হবে কেউ ইচ্ছা করে কোনো অস্বস্তিকর চিন্তা বা কাজ করতে চায় না।


‘স্নায়বিক চাপ নয়, মানসিক চাপ’

মানসিক রোগ বিষয়ে উদাসীনতার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। সচেতনতার অভাব, চিকিৎসকের অভাব, সঠিক চিকিৎসার অভাব, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবসহ অনেক রকমের অভাবের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

তবে, এসবের বাইরেও আরো কিছু বিষয় উল্লেখ কর প্রয়োজন, যা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশে কিংবা সমাজে, এমনকি আমাদের সাহিত্য-(গল্প- উপন্যাস) বা পেপার-পত্রিকায় মানসিক বিষয় বর্ণনাতে ‘মানসিক’ শব্দটির সব সময় সঠিক অর্থ প্রতিফলিত হয় না বলেই ধারণা।
ডাক্তারি বা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে কোনো বর্ণনাতেও মানসিক বিষয়টির বর্ণনা পাওয়া যায় একটু ভিন্নভাবে। দেখা যায় ‘মানসিক চাপ’ বিষয়টিকে বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায় সবখানেই বলা বা লেখা হয় ‘স্নায়বিক চাপ’।
কী খেলাধুলা, কী পরীক্ষা বা যেকোনো ক্ষেত্রে মানসিক চাপ বিষয়টির বর্ণনা করা হয় ‘স্নায়ু’ শব্দটি দিয়ে। বাস্তবে আমরা জানি, স্নায়ু বা মন এক নয়। দুটি ভিন্ন জিনিস।

স্নায়ুর উপর মনের প্রভাব আছে বা মনের উপরও স্নায়ুর প্রভাব আছে, এটি সত্যি। যেমন হরমোনের উপর মনের এবং মনের উপর হরমোনেরও প্রভাবও রয়েছে। তা বলে, হরমোন, স্নায়ু বা মন এক কথা নয়। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয় এবং এদের কাজও ভিন্ন। তাই মনের বিষয় বর্ণনাতে ‘মন’ শব্দটি ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়, তাতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ‘মন’ শব্দটির গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যই বাড়বে। বাড়তে বাধ্য।

স্বাস্থ্যপাতায় যারা লেখেন বা টিভিতে যারা স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন তাদের সবার প্রতি বিনীত অনুরোধ বিষয়টির দিকে সঠিকভাবে নজর দেওয়ার জন্য। অপর দিকে ক্রীড়ালেখক, ক্রীড়া সংগঠকসহ অন্যান্য সকল লেখক বা সাহিত্যিকদের প্রতিও একই অনুরোধ রইলো।

আমাদের প্রতিদিনের জীবনে আরো কিছু শব্দ আমরা প্রায়ই শুনে বা ব্যবহার করে থাকি, যেমন-‘হার্ট দুর্বল’ বা ‘নার্ভ দুর্বল’। মূলত, এ দুটি শব্দও মানসিক চাপ বা চাপের প্রভাবকে প্রকাশ করার জন্যই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব শব্দ ব্যবহার না করে মানসিক চাপ বা দুর্বলতা বোঝাতে ‘মানসিক দুর্বলতা’ শব্দটিই ব্যবহার করাই উচিৎ। শব্দগুলোর পরিবর্তিত ব্যবহারে  মানসিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পারে।

অনেকে হয়তো এ মতামতের সঙ্গে একমত না-ও হতে পারেন যে, মানসিক রোগের গ্রহণযোগ্যতা বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তনের জন্য এসব শব্দের ব্যবহার বা পরিবর্তিত ব্যবহার পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি গল্প বলা যায়- কিছুদিন আগে ‘power of words’ নামের মাত্র ১.৪৫মি. দৈর্ঘ্যের একটি ফিল্মে দেখা যায়, একজন অন্ধ লোক বসে ভিক্ষা করছে, তার সামনে লেখা ‘I m blind please help’. দেখা যায় তাকে সাহায্য করতে খুব কম মানুষই এগিয়ে আসে। কিন্তু একজন মহিলা তার এ অবস্থা দেখে লেখাটিকে পরিবর্তন করে লিখে দেয় ‘ÔIt’s a beautiful day and I can’t see itÕ’ সঙ্গে সঙ্গেই দৃশ্যপটের পরিবর্তন দেখা যায়। তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে করে দেয় অনেকেই। সবশেষে যে কথাটি পর্দায় ভেসে ওঠে তা হলো- ‘Change your words. Change your world.

দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে আমাদের চারপাশে। দৃষ্টিভঙ্গির সামান্য পরিবর্তন পুরো মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিতে এনে দিতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন।

মানসিক রোগ বা মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক দিক আজকে নতুন নয়, এটি সত্যি। অনেক পুরনো। যখন যে কোন মানসিক রোগীকেই রোগী মনে করা হতো না, ধরে নেওয়া হতো অপরাধী। যেহেতু রোগ নির্ণয়ের কোনো উপায় ছিলো না, চিকিৎসা ছিলো না। তাই অপ্রাসঙ্গিক আচরণকে ভাবা হতো অপরাধ প্রবণতা। তাদের প্রতি লোকেদের দৃষ্টিভঙ্গিও তাই ছিলো তেমনই। সে কারণেই হয়তো এদের বা এ প্রসঙ্গে বর্ণনা করতে গিয়ে মানুষ মানসিক শব্দটি এড়িয়ে গিয়ে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছে। আর তাতে ‘মন’ থেকে দৃষ্টিভঙ্গি সরে গেছে অন্যদিকে।

মানুষ মনে হয় আজও তাই মনের সমস্যাকে অন্য কোথাও খুঁজে বেড়ায়। যা কাম্য নয়। কিন্তু এখন তো সবকিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। এখানেও পরিবর্তন জরুরি।

মানসিক রোগ বা মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনাটা জরুরি। অনেক পরিবারের দুঃখ কষ্ট তাতে কমে আসবে। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে আরো কার্যক্ষম হয়ে উঠতে পারবে।


ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।