ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

বলাও যায়না, সমাধানও করেন না নেত্রকোনার স্বাস্থ্যসেবা!

আয়নাল হক, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১২
বলাও যায়না, সমাধানও করেন না নেত্রকোনার স্বাস্থ্যসেবা!

নেত্রকোনা: নেত্রকোনার স্বাস্থ্য সেবার মান এতটাই নিম্নমানের যে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সবকিছু বলাও যায়না। আর তারা সমাধানও করেন না বলে মন্তব্য করেছেন সিভিল সার্জন ডা. শাহিদ উদ্দিন আহমেদ স্বপন।



‘ভাটি অঞ্চল’ খ্যাত নেত্রকোনা জেলায় চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্য সেবার দশা বেহাল। জেলা সদরসহ ১০টি উপজেলায় ২শ ৫২ জন ডাক্তারের স্থলে ১শ ৩১ জনই নেই।

দীর্ঘদিন ধরে এসব পদ শূন্য থাকায় এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একবারে ভেঙে পড়েছে। ডাক্তার যে কয়জন আছেন, তাদেরও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা না থাকায় কর্মরতরাও কর্মস্থলে ফাঁকি দেন বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।

২৫ লাখের বেশি জনবসতিপূর্ণ এ জেলায় চিকিৎসক সংকট থাকায় জেলার অধিকাংশ লোক পাশের জেলার হাসপাতালে ছুটে যান।

সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানা যায়, নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে সিনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি, সার্জারি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালট্যান্ট নাক-কান-গলাসহ (ইএনটি) ৮টি পদ অনেক দিন ধরে খালি রয়েছে।

সিংহের বাংলা উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সহকারী সার্জারির পদটিও শূন্য।

কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

কলমাকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, মেডিকেল অফিসার, আবাসিক মেডিকেল অফিসার থাকলেও শূন্য রয়েছে মেডিসিন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, গাইনি, সার্জারি, চক্ষু, ইএনটি, অর্থো, কার্ডিও, চর্ম-যৌন ও শিশু বিভাগ। সহকারী সার্জন, আইএমও, এনেসথেটিস্ট, ডেন্টাল, ইএমও ও প্যাথলজিস্টও নেই।

এছাড়া লেংগুরা, সিধলী, বড়কাপন, কৈলাটী, কলমাকান্দা, রংছাতি, নাজিরপুর ও খারনৈ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সরকারি সার্জন মিলিয়ে পদ খালি রয়েছে ২৫টি।

মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও একই দশা। জুনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিকেল অফিসার, জুনিয়র কনসালট্যান্ট চর্ম ও যৌন, কার্ডিওলজিস্ট, ইএনটি, মেডিসিন, সহকারী সার্জন, এনেসথেটিস্ট, ডেন্টাল সার্জন নেই।
৮টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে একমাত্র ফতেপুর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সহকারী সার্জারি আছেন। বাকি ৭টিসহ ১৬টি পদই খালি রয়েছে।

কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

কেন্দুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক মেডিকেল অফিসারসহ পদ খালি রয়েছে ২১টি।  

মোহনগঞ্জে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

মোহনগঞ্জে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শুধু ডেন্টাল সার্জন এবং গাগলাজুর, মাঘান ও সুয়াইর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ ৩টিতে সহকারী সার্জারি নেই।

পূর্বধলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

২টি সহকারী সার্জারিসহ পূর্বধলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পদ খালি রয়েছে ৮টি।

খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

ভাটি উপজেলা খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ছাড়া বাকি ১৪টি পদই খালি। ৬টি ইউনিয়নের কোনো উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রেই সহকারী সার্জারি নেই।

বারহাট্টা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

বারহাট্টা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জুনিয়র কনসালট্যান্ট, ডেন্টাল সার্জন, ৬ সহকারী সার্জারিসহ পদ খালি রয়েছে ১০টি।

দূর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

পাহাড়ি এলাকা দূর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসারসহ ৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। মোট পদ খালি রয়েছে ১১টি।

আটপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স:

আটপাড়া উপজেলার অবস্থা একেবারেই নাজুক। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ছাড়া কোনো পদেই লোক নেই। পদ খালি রয়েছে ১৪টি।

সদর উপজেলার অবস্থা:

সদর উপজেলার নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বর্শিকুড়া গ্রামের রতন মিয়া (৫০) জানান, শ্বাসকষ্টের কারণে ৪ দিন ধরে তিনি এখানে চিকিৎসাধীন। এ পর্যন্ত সরকারি কোনো ওষুধ তিনি পাননি। বাইরে থেকে কিনে এনে প্রয়োজন মেটাচ্ছেন।

পুরুষ ওয়ার্ডে কাজীর আমাটি গ্রামের নজরুল ইসলাম (৪৫) অ্যাসিডদগ্ধ আরেকজন রোগীর অভিযোগ, “২০ দিন হয়েছে এখানে এসেছি। কোনোদিনই সময়মতো নাস্তা আসেনি। যাও আসে, বরাদ্দের তুলনায় খুবই কম। ভাত এতই মোটা যে, খাওয়া যায়না। বাড়ি থেকেই সবকিছু এনে খেতে হয়। আর পরিবেশ এতই নোংরা মাঝে মাঝে নাক চেপে রাখতে হয়। ”

ওয়ার্ড পরিদর্শন:

হাসপাতালে ভর্তি সুরাইয়া আক্তার চিকিৎসকের ওয়ার্ড পরিদর্শন সম্পর্কে জানান, দিনে এক/দুবার ডাক্তার পরিদর্শনে আসলেও রাতের বেলা তারা হাওয়া হয়ে যান। তখন নার্স, ওয়ার্ড বয় আর আয়া ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়না। এ অবস্থায় ওয়ার্ড বয় ও আয়ারাই রোগীদের ইনজেকশন পুশ করেন।

বহির্বিভাগ:

মদন উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লক্সে বহিরাগত রোগী গোবিন্দশ্রী গ্রামের জানু মিয়া জানায়, সকাল ১১টার সময় এসেও ডাক্তার দেখিয়ে টাকা দিতে হয়েছে।

মারামারি রোগী হলে ইনজুরি সনদও টাকায় বিক্রি হয় এখানে। দীর্ঘদিন ধরে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এ ব্যবসা চালিয়ে আসলেও তাদের শাস্তি হয়না বলে জানালেন, ভুক্তভোগী রোগীরা।

কর্মকর্তা সংকট সম্পর্কে আটপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সৈয়দ নাসির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, “প্রশাসনিক কাজ সারতেই একজনকে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। এখন যদি হাসপাতালে ১ জন বাদে সব পদই খালি থাকে, তখন তিনি কয়জন রোগীকে দেখতে পারবেন, আপনারাই বলেন!”

এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. শাহিদ উদ্দিন আহমেদ স্বপন বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালগুলোতে জনবল সংকট থাকায় স্বাস্থ্যসেবায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সবকিছু বলাও যায়না। আর তারা সমাধানও করেন না।

অফিস সময়ে চিকিৎসকদের ভিজিট আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। আমি এখানে বসে তো সব সমস্যা সমাধান দিতে পারবোনা। ”

নোংরা পরিবেশের বিষয়ে তিনি বলেন, “অনেক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রয়োজনীয় আয়া, ওয়ার্ডবয় নেই। ”

এজন্য তিনি রোগীদেরও দায়ী করেন। রোগীরা অনেক সময় খেয়ে উচ্ছিষ্ট নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে মেঝেতেই ফেলে দেয় বলে জানান তিনি।

ওষুধের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “এ জেলায় ওষুধের কোনো স্বল্পতা নেই। প্রতিদিন যে সংখ্যক রোগী ইনডোরে আউটডোরে সেবা নিতে আসেন, তার জন্য জেলা সদরে ২শ ৫০ শয্যা হাসপাতাল নির্মাণ খুবই জরুরি। ৫০ শয্যা হাসপাতালে ১০০ শয্যার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ”

তিনি আরও বলেন, “প্রতিটি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা সভাপতি হলেন স্থানীয় সাংসদ। ডাক্তার সংকট মোকাবেলায় তাদেরও সংসদে কথা বলা উচিত। ”

বাংলাদেশ সময়: ১২০৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: রাফিয়া আরজু শিউলী ও শাফিক নেওয়াজ সোহান,  নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।