ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

গ্রামের ঈদ

বিপদজনক পটকা শিশুর হাতে!

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪২ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৪
বিপদজনক পটকা শিশুর হাতে! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর থেকে ফিরে: গত বছরেও এমনটা দেখা যায়নি। বছর দশেক আগের মতোই আবারো বিপদজনক পটকা-বাজি হাতে খেলা করছে গ্রামের শিশু-কিশোররা।

ভয়াবহ শব্দ দূষণ ছাড়াও এ পটকার বারুদে যেকোনো সময় ঘটতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা। শিশুদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অপরাধপ্রবণতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাড়ের উপর দিয়েই শিশুদের হাতে এসব অবৈধ সামগ্রী তুলে দিচ্ছেন অসাধু ব্যাবসায়ীরা।

লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকটি বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, শিশুদের হাতে এসব অগ্নিসহায়ক খেলনার আধিপত্য। পটকা-বাজির সলতেতে আগুন দেয়ার জন্যে সবসময়ই শিশুরা সঙ্গে রাখছে দিয়াশলাই বা গ্যাস লাইটার। ঝুঁকি নিয়ে পটকার সঙ্গে ছোট সলতেতে আগুন লাগিয়েই দৌড় দিয়ে সরে যাচ্ছে তারা। সময়ের হের-ফের হলেই ঘটতে পারে বিপদ।

রাজধানীতে এক সময় শব-ই-বরাতে এবং গ্রামাঞ্চলে ঈদুল ফিতরের সময়টুকুতে প্রচুর পটকা-বাজি ফোটানো হতো। তবে বিভিন্ন দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০৪ সাল থেকে সকল ধরনের পটকা-বাজি নিষিদ্ধ করে সরকার। দশ বছর পর আবারো শিশুদের বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিপদজনক পটকা-বাজি।
গত সোমবার সকালে লক্ষ্মীপুর জেলার থানা রোডে গিয়ে দেখা যায়, একাধিক মনোহরি দোকানে বিক্রি হচ্ছে পটকা-বাজি। লক্ষ্মীপুর মডেল থানার ৫০ গজের মধ্যেই এই দোকানগুলোর অবস্থান।

থানার সামনের অমল চন্দ্রের দোকানের ভেতরে নির্বিঘ্নে পটকা-বাজি বিক্রি হচ্ছে। আর শিশুদের ভিড়তো লেগেই আছে। অবৈধ হওয়াতে এসব পটকা-বাজি রাখা হয়েছে দোকানের ওপরের সিলিংয়ে।

দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, পেপারে মুড়িয়ে শিশুদের মাঝে বিক্রি করা হচ্ছে এসব পটকা। বেলা ১১টার দিকে কমপক্ষে ৫ জন শিশুকে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের পটকা কিনতে। অর্ডার দিলেই সিলিং থেকে নামিয়ে শিশুদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। বিক্রির ভিড় সামলাতে দোকানের একজন কর্মচারীকে শুধু এ কাজেই নিয়োজিত রাখা হয়েছে।

ক্রেতা সেজে দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৬ ধরনের পটকা আর বাজি বিক্রি হচ্ছে এই পাইকারি দোকানে। এখানে একবারে প্যাকেট কিনতে হয় এবং খরচ কিছুটা কম। দেখা যায়, তারাবাতি নামক বিজলীবাতির চাহিদা রয়েছে বেশ।

তামার তারের ওপর বারুদ মেখে কলমের মতো করে বানানো হয় এই বাজি। এই বাজিতে আওয়াজ হয় না। বারুদ মাখানো অংশটুকু বিজলী বাতির মতো জ্বলতে থাকে। শিশুরা তামার খালি অংশ হাতে নিয়ে ঘুরায়। তবে বারুদের অংশের সঙ্গে তামাও পুড়ে যায় অনেক সময়, তখনই শিশুদের হাত পোড়া যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এছাড়াও আগুনের ফুলকিতে শিশুর গায়ের কাপড় এবং বাসার বিভিন্ন স্থানে আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। বিজলীবাতির ফুলকিতে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রবল।

হাতে নিয়ে দেখা যায়, মোড়কের ভাষ্য অনুযায়ী ঢাকার লালবাগের জামাল কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্টিজে তৈরি হওয়া এই তারাবাতি বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদিত! এছাড়াও এ তারাবাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটিকে বিএসসিআইসি কর্তৃক অনুমোদিত বলা হয়েছে প্যাকেটের গায়ে। রাজকুমারী ব্র্যান্ডের এই তারাবাতির এক প্যাকেটের মূল্য ৩৫ টাকা।

‘আঠাশ’ নামে প্যাকেট পটকা বিক্রি করা হচ্ছে শিশুদের কাছে। হাতে নিয়ে দেখা যায়, প্লাষ্টিক প্যাকেটে ২৮টি পটকা মোড়ানো রয়েছে, যেগুলো দেখতে ছোট পেন্সিল ব্যাটারির মতো। ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি প্যকেট।

ফতেপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের হাতে এই পটকা। উঠোনে বিকট আওয়াজ তৈরি করছে এ পটকাগুলো। শব্দ দূষণ ছাড়াও বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর এ পটকার আওয়াজ।

মিরাজ নামে এক শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খোলা দোকানে ‘আটাশ’ নামের এ পটকা প্রতি পিস ২ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আশপাশের দোকানগুলোতেই এসব পটকা খুচরা বিক্রি হচ্ছে।

অমলচন্দ্রের দোকানে বিক্রেতা আরো প্রদর্শন করেন কিট-ক্যাট পটকা। এ পটকার আওয়াজ আরো বেশি বিকট। যত বেশি আওয়াজ তত বেশি দাম। গুলের কৌটার মতো এক একটি পটকা বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা করে।

দোকানদার জানান, কিট-ক্যাটের চেয়েও বিকট আওয়াজ তুলতে সক্ষম ‘চকলেট’ নামের পটকা। এটিও দেখতে গুলের কৌটার মতো। প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে
২০ টাকা করে। এর চেয়েও বেশি আওয়াজের জন্যে রয়েছে ককটেল। এটা কিন্তু হরতালে পিকেটারদের ছোড়া ককটেলের মতোই আওয়াজ হয়। আর বিপদও সে মাত্রার হতে পারে।

চকলেট এবং কিট-ক্যাটের মতো পটকার বিকট আওয়াজে আশপাশের মানুষের কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. নূর-উন-নবী।

তিনি বলেন, শ্রাব্যতার পাল্লা অতিক্রম করলে বিকট আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও দীর্ঘদিনের জন্যে কানের শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পায়। আচমকা আঘাতে স্নায়ু দূর্বল হয়ে বড় ধরনের অসুখের সম্ভাবনাও থাকে।

এছাড়াও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আতশবাজি। বিজলীর ফুলকি ছড়িয়ে আকাশে উঠে যায় এ বাজি। ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব বাজি। আকারে বড় এসব বাজি কাগজের বড় প্যাকেটে মুড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। শিশুরা জামার নিচে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এসব বাজি।

১২ বছরের শিশু রাফির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু আগুনের ফুলকির ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক ধরনের বাজি রয়েছে। যেমন- ঝর্ণা, এটা ফুলকি ছেটাতে ছেটাতে আকাশে উঠে। এটি অনেক সময় উপরে না উঠে পাশে বিক্ষিপ্ত হয়, যেটা ঘরবাড়ির জন্যে বিপদজনক। আবার রয়েছে চরকা। এটি আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে মাটির ওপরে ঘুরতে থাকে।

বাড়ির উঠানে নাসির নামে ৬/৭ বছরের এক শিশুর হাতে সাইকেলের চাকার শিক দিয়ে তৈরি এক বিশেষ ধরনের বাজি দেখা যায়। বাকাঁনো শিকের মাথায় একটু খাঁজ কাটা। সেখানে ম্যাচের কাঠি থেকে বারুদ ছাড়িয়ে ভরা হয়। খাঁজের ওপর পেরেক রেখে দেয়ালে বা শক্ত কোথাও জোরে আঘাত দিয়ে চাপ সৃষ্টি করলেই আওয়াজের সঙ্গে বারুদের গন্ধও পাওয়া যায়। তবে ‘কিট-ক্যাট’ বা ‘চকলেট’ এর তুলনায় এ বাজির শব্দ তেমন একটা কানে লাগে না। শিশুদের খেলনা বিক্রির যে কোন মনোহরদী দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে এ বাজি।
 
শুধু লক্ষ্মীপুর সদরেই নয়, সকল উপজেলা শহরেই পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হচ্ছে এসব পটকা-বাজি। আর বাড়ির সামনের মনোহরি দোকানেও বিক্রি হচ্ছে খুচরা পটকা।

গ্রামের রাস্তায় পুলিশের তেমন আনাগোনা নেই। তবে জেলা আর উপজেলা শহরে পুলিশের নাকের ডগাতেই বিক্রি হচ্ছে এসব ভয়ানক পণ্য। এসব পটকা শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি শিশুদের মানসিক বিকাশকেও করছে বাধাগ্রস্থ।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর সরকারি কলেজের প্রভাষক মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গ্রামে কিছুটা মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠে শিশুরা, যেখানে অভিভাবকদের হাতের লাগাম অনেকটাই ঢিলে। আর এ সুযোগে শিশুদের হাতে বিপদজনক পটকা-বাজি তুলে দিয়ে ধীরে ধীরে সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এক ধরনের অসাধু ব্যাবসায়ীরা। কারণ এ খেলার ছলে এ ধরনের বিপদজনক পটকা-বাজি শিশুদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতাও বৃদ্ধি করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ