ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

‘বাজল কি রে ভোরের সানাই...’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২০৮ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৭
‘বাজল কি রে ভোরের সানাই...’ স্বরলিপিতে মগ্ন নজরুল।

[আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৮তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর শ্রদ্ধাঞ্জলি।]

অবিভক্ত বাংলার প্রান্তিক ও প্রত্যন্ত জনপদ বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে আক্ষরিক অর্থেই একটি মাটির ঘরে শিশুটির জন্ম হয়েছিল। চরম দুঃখ, দারিদ্র্য ও কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাহিত্যসাধনার সকল শাখায় তুঙ্গস্পর্শী সাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি।

ব্যক্তিগত বেদনার নির্বাক জীবন-যাপন শেষে নিজের ডাকনাম ‘দুখু মিয়া’-এর মর্মাথকে সার্থক করে তিনি এখন ঘুমিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিয় মসজিদের পাশে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল-বিশেষজ্ঞ কবি আবদুল কাদির, ‘নজরুল পরিচিতি’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, অখণ্ড বঙ্গদেশের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ সালের ২৪ মে) মঙ্গলবার কাজী নজরুল ইসলাম এক অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। তাঁর পিতামহের নাম আমিনুল্লাহ। কাজী ফকির আহমদের দুটি বিবাহ এবং মোট সাতটি পুত্র ও দুটি কন্যা। সহোদর ভাইবোন বলতে নজরুলেরা তিন ভাই ও একটি ভগিনী। তাঁর জেষ্ঠভ্রাতা কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠভ্রাতা কাজী আলী হোসেন ও ভগিনী উম্মে কুলসুম। কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর চারপুত্রের অকালমৃত্যু হওয়ার পর নজরুলের জন্ম। তাই তাঁর ডাক নাম রাখা হয় দুখু মিয়া।
বর্ধমানের চুরুলিয়ায় এ ঘরেই নজরুলের জন্ম।

কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ছিল একটি নিদ্রিত জাতির মধ্যে মহাজাগরণের ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রবল উত্থানে প্রকম্পিত। নজরুল নিজের একটি গানে যেন সে আবহের জানান দিচ্ছেন:
    ‘বাজল কি রে ভোরের সানাই নিদ মহলার আঁধারপুরে,
    শুনছি আজান গগন তলে অতীত রাতের মিনার চূড়ে। ’

কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকার ১২ জুন ১৯৯৯ সংখ্যায় নজরুল-বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক  ড. রফিকুল ইসলাম ‘সৃষ্টির ভুবনে নজরুল স্বাধীন সম্রাট’ শীর্ষক প্রবন্ধে  লিখেছেন:
‘ফজরের আজানে ‘‘নিদ্রা অপেক্ষা প্রার্থনা (নামায) শ্রেয়’’- এই কথা বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ জাগরণের আহ্বান থাকে। বাঙালি মুসলমান সমাজে নজরুল ইসলামের জন্ম বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণের সূচক। ’

শতবর্ষ-অধিক আগে, একই বছরে (১৮৯৯), একই দেশে, একই ভাষার পরিমণ্ডলে, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে জন্ম নেন দুই বিরল প্রতিভা: নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ। তবু নজরুল ও জীবনানন্দ কবিতায় সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হলেন কী করে? শুধু পরিবেশের ভিন্নতা? পরিবেশ,  ধর্ম, সংস্কৃতি, চিন্তা, দর্শন, জীবনবোধ কিংবা প্রতিভার রহস্যময়তায় এ ভিন্নতা চি‎হ্নিত করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও নজরুলের বৈশিষ্ট্যগত সুস্পষ্ট পার্থক্য কারও কাছেই অনুভব ও বিবেচনার বাইরে থাকে না। সব কিছুকে ছাপিয়ে রুদ্র কাল বোশেখীর মতো দোর্দণ্ড প্রতাপে নজরুল একক ও অনন্য হয়ে আছেন। একটি বিশাল ধূমকেতুর হয়ে তিনি সমগ্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে, এমন কি সমাজ-সংসার আর রাজনৈতিক ইতিহাসকে পর্যন্ত প্রবলভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছেন। নিজের মৃত্তিকালগ্নী গৃহ থেকে জাতির মহাকাশের ধূমকেতুর অস্তিত্বে মহাকালব্যাপী প্রসারিত হওয়া নজরুলের পক্ষেই সম্ভব; যদিও এমন ঘটনা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি বা বিশ্ব ইতিহাসেও অসম্ভব।
সঙ্গীতে মগ্ন নজরুল।

সমকালীন সাহিত্য প্রতিভা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘দুই কবি: দুই বিপরীত মেরুর প্রতিভূ’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন, ‘প্রতিভার বিচারে নজরুল অনেক বেশি উজ্জ্বল। তাঁকে রীতিমতন প্রডিজি বলা যেতে পারে। মাত্র বারো-তেরো বছর বয়সে বালক নজরুল লেটোর দলের জন্য গান ও পালা রচনা করতেন। অত কম বয়স, ক্লাস সিক্স পর্যন্ত বিদ্যে, তাঁর গান ও পালার জন্য পয়সা পর্যন্ত পেতেন, এটা বিস্ময়কর নয়! প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামের মক্তবে, মসজিদ সংলগ্ন পরিবারের সন্তান, তাঁদের ব্যবহারিক ভাষাকে বলা হত ‘মুসলমানি বাংলা’, তাতে আরবী-ফারসি শব্দের প্রয়োগ ছিল স্বাভাবিক, তবু ওই অবস্থাতেই নজরুল বাংলা কবিতার ছন্দ-মিল আয়ত্ত করেছিলেন, এমন কি ইংরেজি শব্দও ইচ্ছেমতন ঢুকিয়েছিলেন। ’

অতএব প্রতিভার সঙ্গে নজরুলের ছিল সাহসী ও বিদ্রোহী মন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একই প্রবন্ধে আরো  জানিয়েছেন, ‘... সৈন্যদলে যোগ দিতে পাড়ি দিলেন করাচি। তাঁর সহপাঠী বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সৈন্যবাহিনীতে যেতে পারেন নি, মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতায় তাঁর পারিবারিক বাধা ছিল, কিন্তু নজরুল সেই মানসিকতা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ’

নজরুলের দৃপ্ত মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় করাচি সেনানিবাসে রচিত ‘বাঁধন হারা’য়। তিনি নিজেই জানাচ্ছেন, ‘আগুন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র, আঘাত, বেদনাÑএই অষ্টধাতু দিয়ে আমার জীবন তৈরি হচ্ছে, যা হবে দুর্ভেদ্য, মৃতুঞ্জয়, অবিনাশী। আমার পথ শাশ্বত সত্যের পথ, বিশ্বমানবের জনম জনম ধরে চাওয়া পথ, আমি আমার আমিত্বকে এ পথ থেকে মুখ ফেরাতে দেব না। ’
 
এমনই প্রবল বিদ্রোহ ও তীব্র সাহসে নজরুল ছিন্ন করেন তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের সাংস্কৃতিক দাসত্ব এবং রাজনৈতিক পরাধীনতার শৃঙ্খল। নিম্নবর্গের মেহনতি মানুষ ও স্বজাতির আত্মজাগরণের মূলস্রোতে তিনি কবিতা, গান, লোকনাট্য, কথাশিল্পকে বেগবতীভাবে প্রবাহিত করে পরিণত হন জাতির স্বপ্ন ও আকাক্ষার সাহিত্য স্রষ্টায়। দীর্ঘ জীবনের মাত্র সামান্য কিছু কর্মময় কালেই তিনি তুলনায় ছাড়িয়ে যান আর সবাইকে; পরিণত হন নিজেই নিজের অনন্য উপমায়। আজকের বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও স্বপ্ন, বাঙালির স্বাধীনতা ও সংগ্রামশীলতা, অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের জাগরণ এবং সর্বপরাধীনতা থেকে রাষ্ট্র ও মানুষের সাংস্কৃতিক-আত্মিক-রাজনৈতিক মুক্তির কথা আমাদের কাছে, আমাদের জন্য, নজরুল ছাড়া আর কেউ এতো সাহসের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলতে পারেন নি; নজরুল ভিন্ন আর কেউই তা-ই আজকের বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বার এতোটা কাছে এসে স্বজনের সহৃদয়তায় দাঁড়াতে পারেন নি; নজরুল ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের জাতীয় কবির স্বীকৃতি এতো সাবলীলভাবে আদায় করে নিতে পারেন নি। ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও জীবনবোধে নজরুল সর্বাঙ্গীনভাবে বাঙালি ও বাংলাদেশের। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আর সকলের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় নজরুলের অনন্যতাই নজরুলের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। স্বনির্মিত পরিচিতিই নজরুলের নিজস্বতা।
বাংলাদেশ ও ভারতের ডাকটিকিটে নজরুল।

ব্যক্তিগত পেশাজীবনে নজরুল বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে। ছিলেন মাত্র দুই বছর। সেখানেই তাঁর আনুষ্ঠানিক সাহিত্যজীবনের সূচনা। করাচি থেকে ডাকযোগে তিনি কলকাতার পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতে থাকেন। পত্র-পত্রিকার সংখ্যা তখন খুব বেশি ছিল না। তবে যেটা খুব বেশি ছিল, তা হলো প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোতে লেখা ছাপানোর ক্ষেত্রে জাত, পাত, অঞ্চল, ধর্ম-বিশ্বাসের বিবেচনাকে এবং অনুগত-বশংবদদের সামনে আনার সম্পাদকীয় কুপ্রবণতা। (এখনও এই অন্ধত্ব, মূর্খতা ও আদিম গোত্রীয় মনোভাব সর্বক্ষেত্রে লুপ্ত হয় নি!) সে সময়ের প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্যচর্চা অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর মুসলমান সমাজের জন্য সাদর ও প্রীতিপূর্ণ ছিল না। সাহায্যকারীর চেয়ে বিরোধীর সংখ্যা ছিল অধিক। সকল ক্ষুদ্রতাকে পদানত করে প্রবল শক্তিতে নজরুল অবিরাম লিখতে থাকেন এবং পত্রিকাগুলোও সেসব ছাপাতে বাধ্য হয়। মাত্র কুড়ি বছর বয়সের মধ্যে তাঁর অনেকগুলো গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ছাপা হয়ে যায়। দুটি পত্রিকা তাঁর রচনা প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। একটি ‘মাসিক সওগাত’ আর অন্যটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’।

যুদ্ধ শেষে নজরুল করাচি-পর্ব শেষে সব কিছু নিয়ে অখণ্ড বাংলার রাজধানী কলকাতায় এসে উঠলেন। কলকাতার তালতলার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে হলো তার অস্থায়ী ঠিকানা। সেই একুশ বছর বয়সেই তাঁর লেখার যথেষ্ট চাহিদা। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর অন্যতম উপন্যাস ‘বাঁধন হারা’। এরপর কলকাতায় তাঁর ঠিকানা হলো পাশেই তালতলা এলাকার ভাড়া বাসা; নজরুলের স্মৃতির স্পর্শে যা ঐতিহাসিক মর্যাদায় ভূষিত। কারণ এখানেই তিনি মাত্র একুশ-বাইশ বৎসর বয়সে এক রাত্রির মধ্যে লিখে ফেলেন ‘বিদ্রোহী’ নামের একটি দীর্ঘ এবং ঐতিহাসিক কবিতা।

‘বিদ্রোহী’ রচনা আসলেই একটি প্রায়-অবিশ্বাস্য, অলৌকিক কাণ্ড। এ কী শব্দ নির্মিত কবিতা, না অনাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিজয়ীর কামান! অবদমিত, ষড়যন্ত্র ও হিংসায় আক্রান্ত, আত্মবিস্মৃতি জাতিকে আগে কেউ বলে নি, ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’। ঘুমন্ত, বিভ্রান্ত, পথভোলা জাতি নজরুলের উদাত্ত আহ্বান শুনে রোমাঞ্চিত হয়ে শীতল রক্তে সৃজিত উত্তাপে জেগে উঠলো। নজরুলের সামাজিক সাম্যতার বাণী এবং রাজনৈতিক চেতনা ও বিশ্বাসের দ্বিধাহীন ও অকপট উচ্চারণে সম্বিত ফিরে পেলো স্তিমিত জাতিসত্তার প্রতিটি সদস্য। পরাধীনতার চেতনা থেকে মুক্তির জন্য ইংরেজ শাসক ও তাদের দোসরদের কাছে আবেদন নিবেদনের বদলে তেজের সঙ্গে গর্জে ওঠে পূর্ণ স্বাধীনতা ও জাতির মুক্তির আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হলো বাংলার মানুষ। ইতিহাস উৎকর্ণ হয়ে লক্ষ্য করল, আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিষয়াবলিতে এত স্পষ্ট, শাণিত ও সোচ্চারভাবে আগে আর কেউ লিখেন নি বা বলেন নি, ৯৫ বছর আগে ঋজু উচ্চারণে যেমন সাহসিক উচ্চারণে বলেছিলেন নজরুল।

বঙ্গবন্ধু ও নজরুল।

অবিভক্ত বাংলার সমগ্র বাঙালি সমাজ এবং অবহেলিত-অবদমিত নিজের মুসলমান সম্প্রদায় ও সমাজকে হৃত গৌরবের আর স্বাধীনতার পথে জাগিয়ে দিতে ঔপনিবেশিকতার সেই চরম দমনমূলক সময়ে নজরুলের মতো এই রকম বিশাল-হৃদয় ও সমুদ্র-সমান সাহসী একজন সাংস্কৃতিক নেতার প্রয়োজন ছিল। ততদিনে বাঙালি সমাজ রামমোহনকে পেয়েছিলেন, বঙ্কিমকে পেয়েছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র, মাইকেল, এমন কি রবীন্দ্রনাথকেও। কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণে বাঙালি সমাজ জেগে ওঠেছিল ধর্ম, দর্শন, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বিশিষ্টতায় ও চৈতন্যে। বাঙালি জাতির সেই সাফল্য ঘুমন্ত বাঙালি মুসলমানকে স্পর্শ করেনি। নজরুল এসে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করলেন সবাইকে। জাতির মূলস্রোতকে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও মিলনে শক্তিপূর্ণ করলেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, ‘রবীন্দ্রনাথ বা অন্যান্য কবিরা যা পারেন নি, নজরুল সরাসরি পৌঁছে গেছেন জনগণের কাছে। রবীন্দ্রনাথ খুবই রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ছিলেন, কিন্তু সেসব বিষয়ে তিনি লিখেছেন নিজস্ব ভাষায়, যা আম-জনতার ভাষা নয়। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক এবং পরবর্তী বেশির ভাগ লেখকের মধ্যেই এই সচেতনতা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। জীবনানন্দ দাশের কোনও লেখা পড়ে বোঝারই উপায় নেই যে দেশটা পরাধীন। কবি বা ঔপন্যাসিক বা সঙ্গীতকার বা সাংবাদিক বা স্বদেশচিন্তকগণের মধ্যে সমকালে একমাত্র ইংরেজের জেল খেটেছেন নজরুল। ’

নজরুলের কার্যকরী জীবনের বিকাশ ও প্রকাশ কাল খুবই সংক্ষিপ্ত। ১৯৪২ সালে যখন কবি চিরনির্বাক হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৪২ বছর। নজরুলের সাহিত্যজীবন মোটামুটি মাত্র বাইশ বছর। তার মধ্যেও প্রথম দশ বছরেই তিনি তাঁর অধিকাংশ বিখ্যাত রচনাগুলো লিখে ফেলেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পর তিনি হয়ে ওঠেন গীতিকার ও সুরকার। নজরুল মাত্র আট-দশ বছরের মধ্যে সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন ঈর্ষণীয় সংখ্যক, যা অনেকে সারা জীবনেও রচনা করতে পারেন নি। এখন পর্যন্ত নজরুলের গানের সংখ্যা তিন হাজারের কাছাকাছি! ‘ধুমকেতু’ পত্রিকাকে অবলম্বন করে নজরুল অনেক কাজ করেছেন। ‘ধুমকেতু’ নামে কবিতাও লিখেছেন। ধুমকেতু শব্দটি তাঁর অতি প্রিয় ছিল। নিজেকে ধুমকেতুর সঙ্গে তুলনা দিতে ভালোবাসতেন তিনি। অকালে রুদ্ধ হয়ে লেখালেখি বন্ধ করতে হয়েছিল তাঁকে। চরম অসুস্থ হওয়ার অনেক আগেই তিনি কবিতা রচনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন; কখনও লিখেও ছিড়ে ফেলেছেন। ১৯৩৬ সালে জসীমউদ্দীনকে একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি সাহিত্যলোক থেকে যাবজ্জীবন নির্বাসন দণ্ড গ্রহণ করেছি। ’
১৯২৬ সালে চট্টগ্রামে বাঁশি বাজাচ্ছেন নজরুল।  নজরুল কী নিজেই জানতেন লেখালেখির জগৎ থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হবে? কেন এই বিদায়, তা তিনি বলে যাননি। ১৯২৯ সালে বন্ধু আজিজুল হাকিমকে একটি চিঠিতে কেবল আভাস দিয়েছেন: ‘আমি এসেছি হঠাৎ ধুমকেতুর মত, হয়ত চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। ’ কাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন তিনি? তারা কী জানে, কেন নজরুলকে অসময়ে রুদ্ধ হয়ে যেতে হলো?

কথাশিল্পী শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জলপ্রপাতের অন্তর্লীন বিষাদ’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে আরো জানা যাচ্ছে:
‘১৯৪৩ সালে নজরুল ও তাঁর পরিবারকে সাহায্য করতে একটি প্রকাশ্য কমিটি হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ। ১৯৫২ সালে নজরুল নিরাময় সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতি কবিকে প্রথমে চারমাস রাঁচিতে রেখে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে দেখান। তারপর তাঁকে ইউরোপ পাঠানো হয় ১৯৫৩ সালের মে মাসে। দেশে ও বিদেশে তাঁকে চিকিৎসার সময় বিধানচন্দ্র (পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা) কবিকে আগাগোড়াই ডাক্তার হিসাবে দেখেন। বিধানচন্দ্র ভিয়েনা গিয়েছিলেন তখন। সেখানেও তিনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নজরুলের চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র ও রিপোর্ট নিয়ে কথা বলেন। ততদিনে কবির আরোগ্য লাভের সব রাস্তা ফুরিয়ে গেছে। ’

নজরুলের সম্বিতহারা অবস্থার আগে বা পরে নজরুলকে নিয়ে যা কিছু করা হয়েছে তার সঙ্গে নজরুলের কোনও সম্পর্ক নেই; তিনি তখন নিজস্ব মতামত প্রদানের সামর্থের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ কথাটিই চিরসত্য যে, কোনও অবস্থাতেই তিনি দখলদার ইংরেজ সরকারের তাবেদারি করেন নি; সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পাণ্ডাদেরকে সমঝে চলেন নি; প্রতিষ্ঠিত গোত্র বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পক্ষপুটে আশ্রয় নেন নি। শুরু থেকে শেষতক পর্যন্ত তিনি স্বজাতির কবি ছিলেন; মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক ছিলেন; জাত-পাত-ক্ষুদ্রতার বিরোধী ও বিনাশী ছিলেন। ইতিহাসকার বিপিন পালও স্বীকার করেছেন যে, ‘নজরুলের শিকড় ছিল দেশজ সংস্কৃতির মাটিতে। ’ সেই দেশটিই আজকের বাংলাদেশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে নজরুলের সমাধি।

বামপন্থি পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক লাডলীমোহন রায়চৌধুরী ‘সাম্যবাদী আদর্শ প্রচারে অন্যতম পথিকৃৎ-কবি’ শিরোনামের এক গবেষণায় জানাচ্ছেন, ‘কলকাতার হরফ প্রকাশনী নজরুলের যে গানের সঙ্কলন গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল তার এক জায়গায় লেখা আছে যে নজরুল নাকি শোকে-তাপে এমনই ভেঙে পড়েছিলেন যে শেষের দিকে তিনি স্বীকার করে যান যে আল্লাহ ছাড়া তাঁর জীবনে কামনা করার আর কিছুই নেই। এই উক্তির মধ্যে তাঁর জীবনের দুঃখ বিড়ম্বিত অশান্ত মনের শান্তির সন্ধানের কথাই ব্যক্ত হয়েছে। জীবনের শুরুতে তিনি নিজের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে যাই পদচি‎হ্ন’। আর জীবন সায়া‎হ্নে এসে সেই একই মানুষ নানা ধরনের শ্যামাসঙ্গীত গানের পালা শেষ করে কবুল করলেন যে আল্লাহ ছাড়া তাঁর আর কিছু চাইবার নেই। ’

বাঙালি সমাজের জাগরণের সাংস্কৃতিক মহানায়ক, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম না এলে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তিতে জাতিসত্তার ঐক্যবদ্ধ পথযাত্রা বিলম্বিত হতো। ‘সংস্কৃতি কথা’ গ্রন্থে  মোতাহের হোসেন চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন, ‘মুসলিম সমাজে রেনেসাঁসের উৎপত্তি হয় নজরুল ইসলাম থেকে’। নজরুল রেনেসাঁর জাগরণী মন্ত্রে অচেতন মুসলিম সম্প্রদায়কে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাঙালি জাতিসত্তার সংগ্রামের মিছিলে নিয়ে এসেছিলেন। মানবতা, মৈত্রী, সৌভ্রাতৃত্বের রাখী বন্ধনে তিনি সমগ্র বাঙালির সকল অংশের মধ্যে ঐক্যের বীজ বপন করেছিলেন। তিনি, কবি নজরুল, সংগ্রামে-সঙ্কল্পে যেমন, মিলন ও ভালোবাসাতেও তেমনি বাঙালি জাতির চেতনার পাখি হয়ে ঘুম ভাঙানিয়া ভোর জাগানিয়া গান গাইতেই থাকবেন। নজরুলের অবিস্মরণীয় গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, সৃজনের প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে বাঙালি জাতি অতীতের মতোই আজ এবং অনাগতকালেও খুঁজে পাবে জাগ্রত চৈতন্যে আত্মবিকাশের অপরাজেয় প্রতীতী ও প্রত্যয়।     

ড. মাহফুজ পারভেজ
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানি, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়্ [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad