ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

পাতা পেড়ে হরিণের সঙ্গে সখ্য

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৭
পাতা পেড়ে হরিণের সঙ্গে সখ্য পেড়ে রাখা পাতা খাচ্ছে হরিণের দল। ছবি: জাকারিয়া মন্ডল

সুন্দরবন ঘুরে: কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়ে সাত সকালেই ঘুমাতে গেলো সূয্যিমামা। আড়মোড়া ভেঙ্গে সদ্য হাসতে শুরু করেছিলো কটকা খালের ওপাশে ক্যাওড়া বনের ওপর। কিন্তু সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আজব এক খেলা শুরু হলো বাঘের অভয়ারণ্যে।

আকাশের মেঘদল যেনো পেঁজা পেঁজা তুলো হয়ে সারি সারি ক্যাওড়া গাছের ফাঁক গলে নামছে। জলাবনের শ্বাসমূল নিংড়ানো পানিতে এমনিতেই থিকথিকে কাদা এদিকটায়।

তারওপর জেঁকে বসা কুয়াশা পুরো জায়গাটার তাপমাত্রা আরো কমিয়ে দিলো যেনো।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ভাসতে শুরু করলো কুয়াশা। একটু আগের উজ্জ্বল হতে থাকা আকাশ আড়ালে পড়ে গেলো সাদা চাদরের। সকাল হতে হতে যেনো সময়টা ফিরে গেলো সুবেহ সাদেকে।  

এমন আবহাওয়ার সঙ্গে সখ্য গড়েই পিচপিচে পলিকাদা মাড়িয়ে হতাশ হতে হলো টাইগার টিলায় এসে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার তো আর এমন বোকা নয় যে এখানে আরাম করে দিব্যি বসে থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে নাকি মামারা এসে ঝিমায় এখানে। ব্রিটিশ আমলে নাকি সাগরের পানি শুকিয়ে লবণ তৈরি হতো জায়গাটায়। ইটের স্তূপ আর মাটির সানকি বুঝি সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

আর জায়গাটা উঁচু হওয়ায় বর্ষা বা জোয়ারে ডোবে না ঢিবিটা। তখন বাঘ আসে এখানে বিশ্রাম নিতে। এ জায়গার নাম তাই টাইগার টিলা। কিন্তু পৌষের এই হাড়কাঁপানো সকালে বাঘ মামার দেখা না পেয়ে ফিরতি পথ ধরতে হলো এক সময়।

কবজি ডোবা কাদা মাড়িয়ে কিছু দূর আসতেই ধরা পড়লো দৃশ্যটা। ক্যাওড়া সারির ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে দূর থেকে তাকিয়ে আছে হরিণের দল। ঠিক যেনো চারিদিকে বৃত্ত রচনা করে মানুষের অনাহুত দলটাকে দেখছে।

গতরাতে টর্চের আলোয় অন্ধকারের ভেতর জ্বলজ্বল করে জ্বলছিলো হরিণগুলোর চোখ। সকালের আলোয় সেই চোখ এখন শান্ত তো বটেই, উৎসুক হয়ে অভিযাত্রীদের দেখছে।

হঠাৎ চোখে পড়লো বনের বাস্তবতাটা। পাতা খাওয়া ক্যাওড়া গাছগুলোর নিচের অংশ অনেকটাই মসৃণ আকার নিয়েছে। যতো দূর চোখ যায়, হাতের নাগালে কোনো পাতা নেই। ঠিক যেনো কেউ কাঁচি দিয়ে ছেঁটে দিয়েছে নিচের ডালগুলো। পেড়ে রাখা পাতা খাচ্ছে হরিণ।  ছবি: জাকারিয়া মন্ডল

কার্যত পায়ের পাতার ওপর ভর করে যতো দূর নাগালে পাওয়া যায়, পাতা খেয়েছে হরিণের দল।   এখন আর ওদের নাগ‍ালে কোনো পাতা নেই। শ্বাসমূল নি:সৃত পানিতে কাদা হওয়ায় নিচেও নেই কোনো তৃণলতা। হরিণগুলো তাই ভুগছে খাদ্য সংকটে।   ডাল ভেঙ্গে নিচে ফেলে দেওয়‍া বানর দলকেও দেখা গেলো না আশপাশে।

বিষয়টি বুঝে একটা কেওড়া গাছের কয়েকটা ডাল ভেঙ্গে নিচে ফেলতেই কান খাড়া হয়ে উঠলো হরিণদলের।   একটু বুঝি দ্বিধায় ভুগলো। তারপর এক দি দু’পা এগিয়ে এলো একটা ধাড়ী হরিণ। আকারে অন্যগুলোর তুলনায় একটু বড়ই এটা।   বন বিভাগের কর্মীরা ওর নাম দিয়েছে মিঠু। নাম ধরে ডাকলেই ছুটে আসে সে। কিন্তু অপরিচিত মানুষগুলোর এমন আচরণ দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে তাদের।  

দ্বিধা কাটিয়ে আর একটু সামনে বাড়লো মিঠু। তার পিছু অন্যরা। একটু এগিয়ে ফের থমকালো হরিণের দল। অপরিচিত মানুষগুলো শিকারী কি না বোঝার চেষ্টা করলো হয়তো। তারপর ফের সামনে বাড়লো। সুন্দরবনে পাতা খাওয়ার চেষ্টা করছে হরিণ।  ছবি: জাকারিয়া মন্ডল

কাদার ওপর ফেলে রাখা পাতা সমেত ক্যাওড়া ডালগুলোর কাছাকাছি এসে গতি বেড়ে গেলো হরিণ দলের। সবার আগে সবুজ পাতায় মুখ ছোঁয়ালো মিঠু। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শ’ খানেক হরিণ জুটে গেলো পাতা খেতে। সব পাতা খেতে সাবাড় করতেও কয়েক মিনিটের বেশী লাগলো না। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে এখন আর ভয় পাচ্ছে না ওরা।

একটু পিছিয়ে আরো কিছু ডাল ভাঙ্গা হলো হরিণদলের জন্য। তারপর আরো কিছু। হরিণগুলোর চোখে ফুটলো অদ্ভূত এক মায়া।   সেই মায়া আর কেবল ওদের চোখেই বাধা পড়ে থাকলো না। ভ্রমণকারীদের ভেতর তা ছড়িয়ে পড়লো সংক্রামকের মতো। ডাল ভাঙ্গার নেশায় পেয়ে বসলো সবাইকে।

কিন্তু বেড়াতে আসা মানুষের এভাবে একটানা ডালভাঙ্গার খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফেরার তাড়া আছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাই ধরতে হলো ফিরতি পথ। বার বার মাথা ঘুরিয়ে তবু চোখ চলে যেতে থাকলো হরিণদলের দিকে। ভাঙ্গা ডালের পাতা সাবাড় করে এবার ওরা যেনো শুধ‍ু মানুষগুলোর চলে যাওয়াই শুধু দেখছে। শব্দহীন ভাষায় কি আর একটু সময় ওদের সঙ্গে থেকে যেতে বললো ওরা?

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়‍ারি ২৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।