ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ফিচার

১৪ই ডিসেম্বরের দল

শেরিফ সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৫ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১১
১৪ই ডিসেম্বরের দল

বর্তমান প্রজন্মকে যদি প্রশ্ন করা হয়- তোমরা জাতিকে কী দিয়েছো? তখন নিশ্চয় বর্তমান প্রজন্ম চুপ করে থাকবে না। তারা গর্বের সাথে বলে উঠবে, ‘আমরা জাতিকে রাজাকার মুক্ত দেশ উপহার দেয়ার চেষ্টা করছি’।

সত্যিই তাই। বর্তমান প্রজন্ম চেষ্টা করে যাচ্ছে এমন একটি দেশের যে দেশে কোনো রাজাকার থাকবে না।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা বাংলাদেশে আলবদর-আলশামস্দের সাথে মিলে হাজার হাজার মানুষ হত্যায় সহযোগিতা করেছে। অথচ স্বাধীন হওয়ার এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও সেই গণহত্যার কোনো বিচার হলো না। জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অনেক লজ্জার। এই লজ্জা বর্তমান প্রজন্ম আর বহন করে নিয়ে যেতে চায় না। তারা এখন যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায়।

বর্তমান প্রজন্মের বহু তরুণেরা এক সাথে হয়ে এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনই কিছু তরুণদের দলের নাম “১৪ই ডিসেম্বরের দল”।  
 
গল্পটার শুরু আজ থেকে ৩ বছর আগে ২০০৮ সালের দিকে। তখনও বাংলাদেশে ফেসবুক তেমন জনপ্রিয়তা পেয়ে ওঠেনি। সেই সময় ফেসবুকে ‘আই হেট পাকিস্তান’ নামে একটি গ্রুপ খোলা হয়। সেই গ্রুপে ধীরে ধীরে সদস্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। না বাড়ার তো কারণ নেই। ফেসবুক ব্যবহার করছে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাই। তারা অনেক সচেতন।   আর ইতিহাসের ব্যপারে তারা আবেগতাড়িত। সেই তাড়না থেকেই একদিন সবাই ফেসবুকে বসেই ঠিক করলো এক সাথে হওয়ার। ডাক পড়লো সকলের। সাড়াও মিলল। প্রায় ১০০-১৫০ জন মানুষ হাজির হয়ে গেলো। যারা গ্রুপটা খুলেছিল তারা তো অবাক!! এ-কি হলো!! এতো মানুষ এসে হাজির হবে কেউ তো আশাই করেনি।

যাইহোক, এরপর ধানমন্ডী লেকে বসে শুরু হয় ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কিভাবে আবার রুখে দাঁড়ানো যায়’। নানান জনের নানান মত। এতো মতের ভীড়ে দেখা যাচ্ছে আসল উদ্দেশ্যটাই হারিয়ে যাচ্ছিল।

তারপরও উদ্যম তো কমবার নয়। কবির ভাষায়- যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার। এই স্লোগান বুকে নিয়েই তো স্বাধীনতা যুদ্ধে এক ঝাঁক তরুণ ঝাপিয়ে পড়েছিল। আর সেখানে স্বাধীন দেশে রাজাকারের বিচার কী খুব কঠিন কিছু? অবশ্যই না। ফেসবুক গ্রুপেই চলতে থাকে তর্ক-বিতর্ক। কাজের ধরণ নিয়ে অনেক সদস্য দল থেকে ছুটেও যেতে থাকে। অবশেষে ঠিক হয় ‘আই হেইট পাকিস্তান’ নামটা বদলে ফেলার। নামটি বদলে হয়ে যায় ‘১৪ই ডিসেম্বরের দল’।
 
কেনো ‘১৪ই ডিসেম্বরের দল’ নাম হলো? এই প্রশ্নের উত্তরে দলের অন্যতম সদস্য বাবু বলেন, এই রাজাকারগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য ছিল আমাদের জাতিকে মেধা-শূণ্য করে দেয়া। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে করে আমাদের দেশীয় দোসরেরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। এই জন্যে তাঁদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ২০০৮ সালের ১৪ নভেম্বর আমরা আমাদের দলের নাম দিয়েছি “১৪ই ডিসেম্বরের দল”।

লক্ষ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাবু আরও বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে জনসচেতনতা তীব্র করা। সেই সাথে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উৎসাহিত করে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করা।

১৪ই ডিসেম্বরের দলের নানান কর্মসূচী:

১৪ই ডিসেম্বরের দল সম্পূর্ণ একটি অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন। বহু মাসের আলোচনার পর এই দল গঠিত হয়েছে। দল গঠনের পর থেকে নানা উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেন। উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে দলের একজন সদস্য বলেন, আমরা ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ডকুমেন্ট্রি মুভি দেখাই। বিশেষ করে ধানমন্ডীর রবীন্দ্রসরোবর, শহীদ মিনারে নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে জোরদার করার চেষ্টা করছে এই তরুণদের দল।

কাজ করতে গিয়ে সকলের কাছ থেকে কেমন সহযোগিতা পান? এই প্রশ্নের উত্তরে বাবু বলছিল, ‘অনেকেই আমাদের কথা শুনে সহযোগিতা করতে চায় কিন্তু কাজের সময় দেখা যায় কেউ নেই। ’ তিনি আরও বলেন, ‘সহযোগিতা করা না হয় বাদই দিলাম। সবাই না হয় সহযোগিতা করে না। কিন্তু দুঃখ লাগে তখন যখন অনেকে আমাদের কাজটি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে। ’

সবচাইতে প্রাণবন্ত উদ্যোগটির কথা জানতে গিয়ে শুনি ২০০৮ সালে ১০ হাজার টি-শার্ট ঢাকার নিম্ন বিত্তদের মাঝে তারা বিতরণ করেছে।   এর পেছনে কারণ ছিল নিম্নবিত্তদেরও যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে সচেতন করে তোলা। এও জানালো যে, শুধুমাত্র তাদেরই সচেতন করা নয়; ধরুন কোনো রিক্সা চালক টি-শার্টটা পেলো। সেই চালক যখন রিক্সা চালাবে তখন তাদের পেছনে বসে থাকা যাত্রী দেখতে পাবে “যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই” লেখাটি।
 
তারা ২০১০ সাল জুড়ে সরকার বিলম্বিত করছে বিচার শিরোনামে একটি লিফলেট বিতরণ করে।   ২০১১ সালেও তারা তাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে যেহেতু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যপারে কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন তাই এখন সেই বিষয়টিতে আটকে না থেকে তারা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানান সমস্যা, ইতিহাস সচেতনতা, দূর্নীতির বিষয়ে জনগণকে ঐক্যবন্ধ করার ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছে।

এই দলে মতের ভিন্নতার কারণে বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ২৭ জন। ২৭ জনের মধ্যে সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এতো কম বয়সে এই ধরনের আন্দোলনে কিংবা সমাজিক কর্মকান্ডে কিভাবে জড়িয়ে গেলেন সবাই? এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই বলে, ‘বয়স তো এটাই। এখন যদি কিছু করতে পারি তবেই তো দেশ এগিয়ে যাবে। আমাদের তো একটি প্রজন্ম স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। আরেকটি প্রজন্ম সৈরাচারি সরকারের হাত থেকে মুক্ত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এখন সময় আমাদের প্রজন্মের কিছু একটা করা। তাই চেষ্টা করে যাচ্ছি। হয়তো কিছুই হবে না। তারপরও চেষ্টা করে যেতে দোষ কী? চেষ্টা আমরা করে যাবো। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫, জুন ১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।