ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

দৃষ্টিহীন গানঅলা মালেকের স্বপ্নগুলি

সোহেল রানা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১১
দৃষ্টিহীন গানঅলা মালেকের স্বপ্নগুলি

‘আমরা প্রেম করিলাম দুজনে আর একলা পুইড়া হইলাম ছাই। /তোমার মনে নাইরে বন্ধু তোমার মনে নাই...!’ এভাবেই গান গেয়ে শোনালেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী আব্দুল মালেক সৈয়দ।



‘গান আমার নেশা। যদি গান নিয়ে সামনে এগোতে পারি, তাহলে গান থেকে যা আয় হবে তাকে তিন ভাগ করবো। এক ভাগ আমার প্রতিবন্ধী ভাইদের জন্য। আর এক ভাগ দিবো আত্মীয় ও দরিদ্র মেধাবীদের জন্য। বাকি যা থাকবে সেটা আমার’। মালেক গান নিয়ে এভাবেই তাঁর স্বপ্নের কথা বলে। আবার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে বলতে গিয়ে একটু হেসে মালেক বলেন- ‘আমার জীবনের সব কিছুই দু’বার ঘটে। আমি বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। আমি মারাও যাবো দু’বার। ছোট বেলায় আমার এমন অসুখ হয়েছিলো  সবাই আমাকে মৃত বলে কাফনের কাপড় নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু দাফনের ঠিক আগ মুহুর্তে আমি ফের নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে উঠি। ’ তারপর আবার হাসতে হাসতে বলে, ‘তবে বিয়ের ক্ষেত্রে হয়তো দু’বার হবেনা’।

প্রতিবন্ধীদের প্রতিভা বিকাশে বৈশাখী চ্যানেল কর্তৃক আয়োজিত ‘অন্য আলোর গান’ শীর্ষক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম ষোলজনের মধ্যে উঠে এসেছিলেন মালেক। তার বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়ার বরুন পাড়া গ্রামে। পিতা মৃত আবদুল আজিজ সৈয়াল এবং মা রোকেয়া বেগম। এই দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়।

মালেকের জন্ম আর সবার মত হলেও জন্মের কয়েক বছর পর থেকেই সে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে।

গান গাওয়ার পর ভাল খারাপ দুই ধরনের মন্তব্যই তাঁর ভালো লাগে। টিভিতে গান গেয়েছেন। সেই সুবাদে অনেকেই চেনেন। গান নিয়ে মন্তব্য করলে কেমন লাগে? এসব প্রশ্নের উত্তরের তিনি বলেন, ‘কেউ আমার গান শুনে ভালো লেগেছে বললে তখন খুব ভাল লাগে। যখন শুনি খারাপ হয়েছে তখন আরো ভালো লাগে। তখন বুঝতে পারি শেখার আরো অনেক কিছু আছে’।

গান কীভাবে শিখলেন এমন প্রশ্নের উত্তরে মালেক বলেন- ‘পাশের বাড়ির বড় ভাই যৌতুক পেয়েছিল একটি টেপ রেকর্ডার। সেখান থেকে জনপ্রিয় শিল্পীদের গাওয়া গান শুনে শুনে শিখেছি। তারপর পাড়ার মানুষ আমার গান শুনতে চাইতো। তখন তাদের বিনোদন দিতেই অনেক সময় গান শিখতে হয়েছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় আমায় প্রশ্ন করা হয়- কোথায় গান শিখেছো? আমি সব সময় বলি শিল্পী রুনা লায়লা আমায় গান শিখিয়েছেন। আসলে তাঁর গান শুনেই তো আমার গান শেখা! তাই তাঁরাই আমার শিক্ষক। তবে ছোট বেলায় যখন সালভেশন আর্মি স্কুলে ভর্তি হই তখন থেকেই আমার গান শেখা শুরু হয়। এরপর স্কুল-কলেজে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করি। অনেক পুরস্কারও পেয়েছি। আমার ঘরে যত পুরস্কার তা সবই আমি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পেয়েছি। ’

তবে মালেক ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। এই বিষয়টিও মালেক অনেক গর্ব করে বলে।

অন্ধত্ব আর আর্থিক অস্বচ্ছলতা কিছুই তাকে পরাজিত করতে পারেনি। নিজের চেষ্টা আর মনোবলই ধাপে ধাপে তাকে তুলে এনেছে। পড়ালোখার খরচ আর শিক্ষাজীবনের বিষয়ে মালিক বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর নড়িয়া সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। পরে উচ্চ-শিক্ষার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। এখানে স্যার এএফ রহমান হলের ২৩১ নম্বর রুমে থাকি। বন্ধুরা সাহায্য করে। তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। আমার প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে আরিফ, রুবেল, রাজু, সোমি, মুক্তা, আকাশ ও শাহজাহানদের কথা না বলেলেই নয়। তারা আমাকে একাডেমিক থেকে শুরু করে সকল বিষয়ে খুব বেশি সাহায্য করে। ’ এছাড়া আর্থিক বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে মালেক জানায়-  মায়ের দেয়া টাকা, বিভিন্ন সংস্থার বৃত্তি, ব্যাংকের দেয়া বৃত্তির টাকায় পড়ালেখা ও অন্যান্য খরচ দিয়ে দিন চলে যায়।

মালেক শুধু গানই জানেনা তার প্রতিভারও শেষ নেই। সে মোড়া তৈরি, বুক শেলফ বানানো, কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন কাজে পারদর্শী। তিনি একজন ভাল সংগঠকও বটে। চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ডিসএবল-এর সভাপতি হতে পারবে বলেও আশা করছে।

তার সাফল্যের মাঝেও প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। তবু তিনি জীবন নিয়ে মোটেও হতাশ নন। তাই সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চান। চান সকলের একটু সহযোগিতা আর ভালোবাসা।

মানুষের কাছে কি আশা করেন? মালেক বললেন, ‘আমি করুণার জীবন চাই না, চাই ভালোবাসায় বেঁচে থাকতে। নিজের যোগ্যতায় আমি প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। ’
   
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০, মে ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।