ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন ডাক্তারদের এগিয়ে যাওয়া

‘যখন কেউ থাকে না তখনও ওরা থাকে’

আশিকুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫০ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১১
‘যখন কেউ থাকে না তখনও ওরা থাকে’

একজন রোগী যখন কয়েক জায়গা ঘুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসে তখন তাদের অনেকেরই সহায় সম্বল বলতে আর কিছুই থাকেনা। তখন ঢাকা মেডিকেলের এই তরুণ প্রাণ ইন্টার্নী ডাক্তারেরাই এগিয়ে আসে।

তাঁদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে তুলতে। তাঁদের কথাই জানাচ্ছেন আশিকুর রহমান।

“লিভার অ্যাবসেস ড্রেইন করবে কে?... আর কালকের রোগীটা কী  নেবুলাইজেশন পেয়েছে?”

সকাল ১০টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালের ২১৯ নাম্বার ওয়ার্ডে পা দেয়ার সাথে সাথেই চোখে পড়ল ইন্টার্নী ডাক্তারদের সকালের ব্যস্ততা। চারিদিকে হৈ-হৈ চেঁচামেচি। এর মধ্যেই সবাই ব্যস্ত। একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম দেখলাম কিছু তরুণ ডাক্তার সাদা এপ্রন পরে আর গলায় স্টেথস্কোপ ঝুলিয়ে একজন রোগীর বিছানার পাশে একটা এক্স-রে প্লেট নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা আলোচনা করছেন। এবার একটু দূরেই একজন তরুণ ডাক্তারকে দেখে এগিয়ে গেলাম। তখন তিনি পরম মমতায় রোগীর কাঁধে হাত রেখে তার অসুবিধার কথা শুনছেন। বললাম- আপনাদের ইন্টার্নী ডাক্তারদের সাথে কথা বলতে চাই। তরুণ ডাক্তার সজীব বললেন ‘দেখতেই পাচ্ছেন অনেক কাজের চাপ, একটু বসুন। ’

আমাকে ইন্টার্নী ডাক্তারদের কক্ষে বসিয়ে তিনি চলে গেলেন কাজে। কিছুক্ষণ পর রুমেই কথা হল ডা: মামুন, রাজিন, দিশা, নিপা, প্রিয়াংকা, নার্গিস, সাকিব, মিশু, রিয়াদ, দিতি, ইফতেখারদের সাথে। লক্ষ্য করলাম সবার ভিতরেই কিছু একটা করার প্রেরণা।

শুরুতেই জানতে চাইলাম কেমন লাগছে নতুন ডাক্তার হয়ে। রাজিন বললেন- ‘ভালই। যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম তখন থেকেই ভাবতাম কবে যে পাশ করে মানুষের জন্য কিছু করতে পারব। এখন সে সুযোগটা পেয়ে খুবই ভাল লাগছে। ’

এরপর তারা সবাই সারাদিনের কথা বলার সময় জানতে পারলাম, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে কোনো রকম বিরতি না দিয়েই শুরু হয় কর্মচাঞ্চল্য। চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত।

২১৯ নাম্বার ওয়ার্ডে বর্তমান রোগীর সংখ্যা প্রায় ৯০ জন। এত রোগী সামলাতে কোন কষ্ট হয়না? উত্তরে দিশা জানায় ‘তা তো হয়ই, কিন্তু রোগীরা যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যায় তখন খুব ভাল লাগে। অনেকেই আমাদের জন্য দোয়া করে যান। ’ এতো খুশীর মাঝেও আবার কোন রোগীর মৃত্যুতে তাদের মধ্যে নেমে আসে  শোকের ছায়া। এই কথাটি জানাতেও তারা ভুলেনি।

রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে কী কী ধরনের সমস্যার মধ্য পড়তে হয় জানতে চাইলে তাঁরা বলেন এমনিতে ঔষধ নিয়ে ঢাকা  মেডিকেলে কোন সমস্যা নেই। পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ আছে। তবে আইসিইউ-এর (ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট) বেড সংকটের কথা জানালেন  কেউ কেউ। মাত্র ৬টি বেড নিয়ে চলছে আইসিইউ। এতে করে Diabetic ketoacidosis, respiratory failure, Guillain Barre Syndrome-এর মত মুমূর্ষ রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে যথেষ্ঠ হিমশিম খেতে হয়।

তবে তাঁরা আশা প্রকাশ করেন পাশের নতুন ১৪তলা ডিমসি-২ ভবনটি চালু হয়ে গেলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। মাঝে মাঝে কিছু কিছু রোগী অন্যায় রাজনৈতিক চাপ তৈরি করেন বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন। ডাঃ রাজিন বলেন, ‘একজন রোগীকে সাহায্য করতে যতটুকু সম্ভব তার পুরোটাই করেন তাঁরা। ’

একজন দরিদ্র রোগীর রেনাল বায়পসির জন্য অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুরু করে রোগীর সাথে যাওয়ার পুরো দায়িত্ব নেয়ার কথা জানালেন অনেকে।   ডা: নিপা জানালেন, দরিদ্র রোগীদের জন্য তারা নিজেরাই দরিদ্র তহবিল তৈরি করে রাখেন। যদি কখনো তহবিলের আর্থিক টানাপোড়েনও থাকে তখন নিজেরাই বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ঔষধ জোগাড় করে দেন। ভাল লাগার স্মৃতির কথা জানতে চাইলে ডা: সজীব তার জীবনের একটা ঘটনার কথা জানালেন।  

‘গত বাণিজ্য মেলায় আমি আমার ছোট ভাইয়ের সাথে মেলায় গিয়েছিলাম। এক চিপস্ বিক্রেতার কাছ থেকে ছোট ভাইয়ের জন্য চিপস্  কেনার পর যখন আমি টাকা দিতে চাই, তখন চিপস্ বিক্রেতা আমার কাছ থেকে দাম নিতে চায়না, কেন নেবে না জানতে চাইলে সে আমাকে জানায় তার ভাই যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল তখন আমরাই তার চিকিৎসা বিনামূল্যে করেছিলাম। তাই সে দাম নেবে না। আমার চোখে তখন পানি চলে আসছিল। এমন সম্মান কয়-জনের ভাগ্যে জোটে। ”

এত কাজের চাপ তারপরও যেন কোনো ক্লান্তি নেই। কাজের ফাঁকেই  দেখলাম প্রিয়াংকা, মাহমুদ পড়াশোনা করছেন।

এত কাজের পরেও নিজেদের জন্য কী কিছু সময় পাওয়া যায়? তাদের প্রশ্ন করলাম। মামুন জানালেন, ‘খুব বেশী সময় পাওয়া যায় না। দুপুরে ডাইনিং-এ কিছুক্ষণ আড্ডাবাজি হয়। তবে আমরা মাঝে মাঝে কাজ শেষে ঘুরতে যাই। ’

২১৯ নাম্বার ওয়ার্ডের রোগীদের সাথে কথা বলে জানতে পারি তাদের চিকিৎসার কোন ধরনের সমস্যা হয়না এবং তাদের প্রয়োজনমত সকল ঔষধ তাঁরা কোন ঝামেলা ছাড়াই পেয়ে যান। আরেক রোগীর আত্মীয় আগ বাড়িয়ে আমার কাছে এসে বলে, ‘এইখানে সারাদিন যে ধকল যায় তা আপনে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। কিন্তু সত্যিই বলছি যখন এই হাসপাতালে কেউ থাকে না তখনও এই ছেলে-মেয়েগুলো আমাদের পাশে থাকে। ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তার বন্ধুকে দেখতে এসেছে। সেও বলছিল, ‘সংবাদপত্রে খালি বলা হয়- ঢাকা মেডিকেল কলেজে অনেক সমস্যা। ঠিক মতো সার্ভিস পাওয়া যায় না। শুধু নেগেটিভ নিউজ। কিন্তু এই বিষয়গুলো তো পজিটিভ। কেউ তো বলে না এতো সমস্যার থাকা সত্ত্বেও আমাদের ডাক্তাররা কী পরিমাণ কষ্ট করে যাচ্ছে। ’

২১৯ নাম্বার ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে ইমার্জেন্সী এবং ক্যাজুয়াল্টি বিভাগে  গেলে পরিচয় হয় ডাঃ গৌরবের সাথে। নিবিড় মনযোগের সাথে তিনি তখন সড়ক দূর্ঘটনার শিকার একজন রোগীর হাতের টেনডন সেলাই করছিলেন। জানতে পারলাম যদিও তাঁর ক্যাজুয়াল্টিতে এখন ডিউটি না। তারপরও তিনি এখানে কাজ করছেন নিজের বিবেকের তাগিদে। এতে কিছু নতুন জিনিসও শেখা হয়।

একজন রোগী যখন কয়েক জায়গা ঘুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসে তখন তাদের অনেকেরই সহায় সম্বল বলতে আর কিছুই থাকেনা। তখন ঢাকা মেডিকেলের এই তরুণ প্রাণ ইন্টার্নী ডাক্তারেরাই এগিয়ে আসে। তাঁদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে একজন মুমূর্ষু  রোগীকে বাঁচিয়ে তুলতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবেদিত প্রাণ ইন্টার্নী ডাক্তারদের চোখের দিকে তাকিয়েই যেন বাঁচার প্রয়াস পায় অসংখ্য অসহায় মানুষ।


বাংলাদেশ সময়: ১৪২০, মে ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।