ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ফিচার

হজরত শাহজালালের (র.) স্মৃতিবিজড়িত ‘লাকড়ি তোড়ার মেলা’

তাহজিব হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১০
হজরত শাহজালালের (র.) স্মৃতিবিজড়িত ‘লাকড়ি তোড়ার মেলা’

মাথায় লাল কাপড়, হাতে নিশান। সামনে ব্যান্ডদল।

হজরত শাহজালালের (র.) মাজার প্রাঙ্গণ থেকে কুচকাওয়াজসহ হাজার হাজার মানুষের যাত্রা শুরু। উদ্দেশ্য লাক্কাতোড়া। এ দলটি লাক্কাতোড়ায় কোনও সভা-সমাবেশ অংশ নেবেন না। তারা সেখানে লাকড়ি সংগ্রহ করবেন।

এটি হচ্ছে হজরত শাহজালালের (র.) স্মৃতিবিজড়িত ‘লাকড়ি তোড়ার’ মেলার বিজয় মিছিল।

প্রতি বছর শাওয়াল মাসের ২৬ তারিখে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সে হিসেবে আজ ৬ অক্টোবর বুধবার সিলেটের মাজার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ‘লাকড়ি তোড়ার’ মেলা। এ মেলাটি আর পাঁচটি মেলা থেকে একেবারেই আলাদা।

বুধবার সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ মাজার প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকেন। জোহরের নামাজ শেষে মাজারের প্রধান খাদেম ইউসুফ আমান উল্লাহর ছেলে খাদেম ফতোল্লাহ আল আমানের নেতৃত্বে সবাই লাক্কাতোড়ায় উদ্দেশে রওনা দেন। এই দলে অংশ নেন বিভিন্ন দল, মত, শ্রেণী, পেশার মানুষ। আর এই মিছিলে ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবাই একাকার হয়ে যান। কারো মাঝে কোনও ভেদাভেদ থাকে না। সেখান থেকে সবাই মিলে লাকড়ি সংগ্রহ করে বিকেলের আগেই মাজারে ফিরে আসেন। পরে মাজার প্রাঙ্গণে সবার খাবারের আয়োজন করা হয়।

এবারের খাবারের আয়োজনে ছিল আর এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রায় ৯০০ কেজি চালের খিচুড়ি রান্না করা হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় ৫ বস্তা ডালের। আর এসব কাজে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে অংশ নেন হযরত শাহজালালের  প্রায় সাড়ে তিন শ ভক্ত।

মৌলভীবাজার থেকে এসে এ  মেলায় অংশ নেন মযির চৌধুরী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এ মেলায় এসে যে আনন্দ করেছি, ঈদের দিনেও এত আনন্দ করতে পারি না। একই কথা জানালেন ফেনী থেকে আসা ব্যবসায়ী আজগর খান।

মাজারের খাদেম ও হযরত শাহজালালের ইতিহাস গবেষক এস এ আহমদ কবির বাংলানিউজকে বলেন, এখানে শায়কের মৃত্যুর পরের বছর থেকে মহা ধুমধাম ও জাঁকজমকের সাথে এটি পালিত হয়ে আসছে। তবে ইংরেজ শাসকদের বাধানিষেধের কারণে ইংরেজ আমলে এটি ধুমধামের সাথে পালন করা সম্ভব হয়নি। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আবার এটি হারানো গৌরব ফিরে পেয়েছে।

এ মেলার ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করতে গিয়ে খাদেম এস এ আহমদ কবির বলেন, একদিন মহান দরবেশের দরবারে এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা হাজির হন। তিনি হজরত শাহজালালের কাছে তার দুই মেয়ের ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন জানান। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে মহান দরবেশ ভক্ত ও অনুসারীদের নিয়ে কুচকাওয়াজসহ বর্তমান লাক্কাতোড়া এলাকার গভীর জঙ্গলে যান। সেখানে সবাইকে নিয়ে তিনি লাকড়ি তোলার নির্দেশ দেন এবং নিজেও তা করেন।

লাকড়ি সংগ্রহ করতে করতে দরবেশ তার সঙ্গীদের নিয়ে অল্প এক উঁচু টিলায় বিশ্রামের জন্য বসেন। সেই থেকে এলাকাটির নাম হয় লাক্কাতোড়া। বিশ্রাম শেষে তিনি লাকড়িসহ সঙ্গীদের নিয়ে দরবারে ফিরে আসেন। তারপর আসরের নামাজ শেষে তিনি দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশে বললেন, আমরা আজ কী কাজ করলাম? সবাই উত্তর দিলেন, লাকড়ি কেটেছি। তারপর দরবেশ সবার উদ্দেশে আবার বললেন, তাহলে আজ থেকে আমরা সবাই কাঠুরিয়া। উপস্থিত সবাই সম্মতিসূচক আওয়াজ দিলেন।

তারপর দরবেশ বললেন, এই লোকটি কাঠুরিয়া। তার দুটি বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে। তোমার মধ্যে কারা তাদের বিয়ে করতে রাজি আছো? অনেকে হাত তুলে সম্মতি জানালে হযরত তাদের মধ্য থেকে দুজন উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করে মেয়ে দুটির বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। এরপর ভক্তরা তাকে জিজ্ঞেস করলেন এখন আমরা লাকড়ি দিয়ে কী করব? তিনি উত্তরে বললেন, রেখে দাও কাজে লাগবে।

এ ঘটনার ২২ দিন পর তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর খবর শুনে নানা জায়গায় থেকে প্রচুর মানুষ তার দরবারে জড়ো হন। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য প্রচুর লাকড়ির প্রয়োজন হয়। তখন এই সংগৃহীত লাকড়ি দিয়ে তাদের রান্নার ব্যবস্থা করা হয়।

এছাড়া ২৬ শাওয়ালে গৌড়গোবিন্দর কাছ থেকে সিলেট জয় করেন হজরত শাহজালাল। এসব স্মৃতি ধরে রাখার জন্য প্রতি বছর চাঁদের তারিখ হিসেবে ২৬ শাওয়াল বিজয় মিছিল ও ‘লাকড়ি তোড়ার’ মেলার আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২২৫, অক্টোবর ০৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।