ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বিনোদন

দুই বন্ধুকে পোড়াচ্ছে এন্ড্রু কিশোরের ফেলে যাওয়া স্মৃতি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৩ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০২০
দুই বন্ধুকে পোড়াচ্ছে এন্ড্রু কিশোরের ফেলে যাওয়া স্মৃতি

রাজশাহী: ‘এন্ড্রু কিশোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় থেকেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তখন এতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বিভিন্ন জায়গা থেকে ছেলে-মেয়েরা পড়তে আসে। ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ছাত্ররা তাকে নিজ নিজ এলাকায় নিয়ে যেতো। তখন থেকেই তার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। পরে সে সিনেমায় গান গাওয়া শুরু করে।’

বাংলা সংগীতাঙ্গনে অসামান্য প্রতিভা, অসম্ভব শ্রোতাপ্রিয় শিল্পী অসংখ্য কালজয়ী গানের কণ্ঠসৈনিক এন্ড্রু কিশোরকে স্মরণ করে এমনটাই বলেছেন তার বন্ধু দেশের আরেক প্রতিভাবান বিশিষ্ট নাট্যকার ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর মলয় ভৌমিক।

বাংলাদেশের আধুনিক ও চলচ্চিত্রজগতের অসংখ্য গানের কণ্ঠের জাদুকর এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে।

তার প্রস্থানের খবর ছড়িয়ে পড়তেই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন দেশের শিল্প-সংস্কৃতি অনুরাগীরা। ব্যক্তি এন্ড্রু কিশোরকে জানতে বাংলানিউজ কথা বলেছে তার ঘনিষ্ঠ দু'জন বন্ধুর সঙ্গে। তাদের স্মৃতিপট থেকে উঠে এসেছে শিল্পীর বর্ণাঢ্য জীবনের নানান দিক।

তার বন্ধু নাট্যকার মলয় ভৌমিক বলেন, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ থেকে আমরা একসঙ্গে ১৯৭৮ সালে মাস্টার্স পাস করেছি। যদিও সে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র ছিল। ১৯৭৫ সালে সে স্নাতক পাস করে। ছাত্রাবস্থায় গান গাইতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতো। তাই স্নাতক পাসের পর দুই বছর ড্রপ হয়ে যায়। পরে আমাদের সঙ্গে মাস্টার্স পাস করে। তাই বলতে গেলে সে আসলে আমাদের সামনেই এন্ড্রু কিশোর হয়ে উঠে। একজন নিপাট সাদাসিধে মানুষ শেষ দিনটি পর্যন্ত কারও প্রতি কোনো অভাব-অভিযোগ করেনি। বলা যায়, নিজেকে অনেকটা আড়াল করেই অজানা অভিমানে নিভৃত জীবন বেছে নিয়েছিল এন্ড্রু।

স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, এন্ড্রু কিশোর রাজশাহীর সন্তান ছিল। তার মা রাজশাহীর খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালের সিনিয়র নার্স ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর থেকে আমরা একইসঙ্গে অনুষ্ঠান করতে যেতাম। সে কোনো অনুষ্টানে গান গাইতে গেলে আমি সেখানে উপস্থাপনা করতাম। আমাদের মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অনেক সময় কোনো অনুষ্ঠানে গেলে উপস্থাপনা কে করছে সে জানতে চাইতেন। তখন উপস্থাপনার জন্য তিনি আমার নাম বলতেন।

নাটকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কারপ্রাপ্ত এ অধ্যাপক আরও বলেন, সে কখনো নিজের অতীত ভুলে নি। ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দু’বার অ্যালামনাই অনুষ্ঠানে সে এসেছিল এবং গানও শুনেছিলো। সে যখন আসতো আমরা ঠিক আগের মতোই আড্ডা দিতাম। একসঙ্গে থাকা, ঘুরাঘুরি আরও কত কি...! তার মধ্যে ছেলেমানুষি স্বভাব ছিল। তার গানের ঐশ্বর্যে অন্তত তিন প্রজন্মের মানুষ বিমোহিত হয়ে আছে। এটা তার অবিস্মরণীয় সাফল্য।  এন্ড্রু কিশোরের মত একজন গুণী শিল্পীর  প্রয়াণে সঙ্গীত জগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হলো।

এন্ড্রু কিশোরের আরেক বাল্যকালের বন্ধু রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. দ্বীপকেন্দ্র নাথ দাস। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান তিনি। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে তার সম্পর্কটা 'তুই-তুই'। যারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ অথবা একটা ভালো পজিশনে আছে তাদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা শ্রদ্ধার। কিন্তু আমার সঙ্গে সেরকমটা ছিল না, থাকা উচিতও নয়৷ তার সঙ্গে সম্পর্কটা হয়েছে সংগীত বিদ্যালয়ে।

সুর বাণী সংগীত বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল সে৷ সেখানে আমি হাওয়াইন গিটারের ছাত্র ছিলাম৷ যেহেতু বয়স কাছাকাছি ছিল, সেহেতু তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। তাছাড়া পরে দুজনেই যখন সিটি কলেজে ভর্তি হলাম, সেখান থেকেই আমাদের পথচলা৷

এন্ড্রু কিশোরের কোনো স্মৃতি সবচেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে?- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যখন আমি শিক্ষকতায় আসি, তখন তার সঙ্গে 'তুই-তুকারি' সম্পর্কই ছিল৷ কিন্তু কিছুদিন পর সে আর আমাকে নাম ধরে ডাকে না। বলতো, স্যার কেমন আছো? তখন 'তুমি' হয়ে গেল৷ পরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে, তুই আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিলি? সে বললো, 'না, দূরত্ব নয়৷ তুমি একজন প্রফেসর মানুষ, তোমার তো সমাজে একটা মূল্যায়ন আছে। আমরা যদি তোমাকে সম্মান না দেই তাহলে অন্যরা কীভাবে সম্মান দেবে?' এই যে একটা ব্যাপার, এই জিনিসটা আমার এখন খুব মনে পড়ছে!

এন্ড্রু কিশোর সংগীত জগতে এতো উচ্চতায় উঠেও নিরহংকারী ছিলেন উল্লেখ করে ড. দ্বীপকেন্দ্র নাথ বলেন, সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, আমরা অনেক সময় দেখি, কেউ একজন বড় শিল্পী হয়ে গেলে তার মধ্যে একটা 'অহংকারবোধ' চলে আসে৷ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না৷ কিন্তু এই দিকটা আমার বন্ধু কিশোরের মধ্যে ছিল না৷ সে আমার সঙ্গে ক্যাম্পাসে গিয়ে রিকশাওয়ালার সাথেও ছবি তুলেছে৷ মানুষের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ছিল৷ জীবনের অন্তীম সময়েও বলে গেছে 'ভালো থেকো, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করো। ’

সদ্য বন্ধুর এমন স্মৃতিচারণে কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে প্রফেসর ড. দ্বীপকেন্দ্র নাথ দাসের।  এ সময় দেশের নবাগত শিল্পীদের জন্য এন্ড্রু কিশোরের অবদানের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা সঙ্গীত জগতে নতুন আসে কিশোর তাদেরকে সাহস দিতো, স্টেজ ফ্রি করতো৷ এইটা তার একটা ভালো গুণ। সে নতুন শিল্পীদের উদ্দেশ্যে সবসময় একটা কথা বলতো৷ সে বলতো, ‘এখন শিল্পী তৈরী হয় না, তৈরী হয় পারফর্মার। কোনো রকম গান শিখলো বা শিখলো না, আর স্টেজে উঠে গেল। ফলে আমাদের দেশে 'শিল্পী' তৈরী হচ্ছে না। '

বাংলাদেশ সময়: ২৩০৩ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০২০
এসএস/ওএফবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।