ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

বিনোদন

পালিয়ে গেছে ‘বিবেক’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৮
পালিয়ে গেছে ‘বিবেক’ ফাইল ছবি

ঢাকা: অত্যাচার, নিপীড়ন যখন চরম পর্যায়ে, তখন পিনপতন নিরবতা চারদিকে। কেবল বেজে চলছে করুণ সুর। চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না আর কেউ। যেন নিজেই হচ্ছে অত্যাচারিত। তখনই হাতে একতারা নিয়ে কিংবা তসবি হাতে হাজির কোনো দরবেশ অথবা ‘পাগল’। যার নাম ‘বিবেক’।

খোদা, ভগবান কিংবা মওলার নাম ধরে আবেগমাখা প্রতিবাদী দরাজ কণ্ঠে ‘বিবেক’ ধরেন কোনো গান। যে গান শোনায় শোষণ, নিপীড়ন আর অন্যায়ের প্রতিবাদের বাণী।

যার গানেই সাবধান করে দেওয়া হয় অত্যাচারীকে।
 
‘বিবেক’ বাংলার হাজার বছরের ঐহিত্য যাত্রাপালার এক জনপ্রিয় চরিত্র। তবে শহরে এখন যাত্রাপালার তেমন কোনো আবেদন নেই বললেই চলে। গ্রামে যাও রয়েছে, নেই পালা মঞ্চায়নের অনুমোদন। তাই পালিয়ে গেছে সেই বিবেকও। যা কিনা স্বশরীরে সবার সামনে হাজির হয়ে জাগ্রত করে দেয় সবার ভালো মানসিকতাকে। উচাটন করে দেয় মানবিকতাকে।
 
নব্বই সাল পর্যন্ত রমরমা ছিল যাত্রাপালা। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পুরো পাঁচ বছর জুড়েই ছিল নিষেধাজ্ঞা। সে সময় বলা হতো পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত যাত্রাপালা নিষিদ্ধ থাকবে। এভাবে একটি নির্দেশনা দেওয়ার পর প্রায় বছরখানেক পরে তা তুলে নিয়ে আবারও কয়েকদিন পর একই নির্দেশনা দিতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
 
সে সময় অনেক যাত্রা দলের মালিক পথে বসেন। কেননা, যাত্রা দলের শিল্পীরা বেতনভুক্ত। বছরের পর বছর ধরে কোনো আয় না করে দলগুলো শিল্পীদের বেতন পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।
 
এরপর ক্ষমতার পালা বদলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী দল ক্ষমতায় এলে আর নিষেধাজ্ঞা পড়েনি। ততদিনে ১০০টিরও বেশি দল বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়টা ছিল তারা পালা করতে পারতো না। কেননা, সরকার থেকে অনুমোদনের কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) অনুমতি দিতেন না। এই অবস্থায় পরবর্তী ১০টি বছর কেটে যায়। ২০০৮ সালে আবারও বর্তমান ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রপরিচালনায় এলে একটি নীতিমালা করা হয়। যেখানে যাত্রা দল নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়। যারা ডিসির কাছে আবেদন করে পালা মঞ্চায়ন করতে পারেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে যাত্রাপালার সেই বিবেক আজ অবিবেচনায় নিমজ্জিত। কেননা, নীতিমালায় বলা আছে, কোনো যাত্রা দল তার প্যাডে পালা মঞ্চায়নের জন্য ডিসির কাছে আবেদন করলে সাতদিনের মধ্যে অনুমোদন দেবে। আর অনুমোদন দেওয়া না গেলে তার সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে জানিয়ে দেবে। কিন্তু ডিসির কাছে আবেদন গেলে তা প্রথমে যায় পুলিশ সুপারের (এসপি) দফতরে। এসপি পাঠায় ওসির (থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) কাছে। এই তিন টেবিলে আবেদন ঘুরতে ঘুরতে সময় পেরিয়ে যায় অনেক। আর যাত্রাপালার মৌসুম হচ্ছে শীতকাল। সময়টা পেরিয়ে গেলেই আর পালা মঞ্চায়ন করা হয় না।
 
যাত্রা দলের সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের তরফ থেকে কোনো বাধা না আসলেও নানা অজুহাতে যাত্রা পালার অনুমোদন দেন না ডিসিরা। ফলে যে ৩০-৩৫টি দল এখনও চলছে, সেগুলো অনেকটা ভাসমান অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা দাবি জানিয়ে আসছে, ‘জাতীয় যাত্রামঞ্চ’ তৈরির। কিন্তু তাতে কেউ গা করছে না। এতে হাজার বছরের এ ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়েছে।
 
বিভিন্ন রেফারেন্স ঘেঁটে দেখা গেছে, যাত্রার ইতিহাস হাজার বছরের হলেও এটি অভিনয়ের জায়গায় চলে আসে ১৫০৯ সালে। তার আগে জায়গায় জায়গায় ঘুরে শিল্পীরা কীর্তন করতেন দেব-দেবীদের নানা কাহিনী নিয়ে। এই জায়গা বদল করে করে এই উৎসব হতো বলে সেখান থেকেই এর নাম হয়েছে যাত্রাপালা।
 
চৈতন্য দেবের পৃষ্ঠপোষকতায় যাত্রাপালা আধুনিক রূপ লাভ করে। প্রথম পালাটির নাম ছিল ‘রক্ষীনী হরণ’। এই পালাটির পর দু’শো বছর আর কোনো পালা হয়নি। ১৭০০ সাল থেকে এটি আবার শুরু হয় পুরোদমে। যাত্রাপালার চরম বিকাল হয় উনবিংশ শতকে। বিংশ শতকের শেষে দিকে এসে রুগ্ন হয়ে পড়ে। আর একবিংশ শতকে এসে এটি ভগ্নদশায় পর্যবসিত হয়েছে।
 
এক সময়ে নামকরা দল বাবুল অপেরা, জয়দুর্গা অপেরা, বাসন্তী অপেরা, শতত অপেরার ছিল বেশ নামডাক। এখন আর সেগুলো নেই। তবে এখন যারা টিকে আছে তাদের মধ্যে আনন্দ অপেরা, দেশ অপেরা, বহ্মপুত্র অপেরা, তিতাস নাট্যসংস্থা কোনোভাবে লড়াই করে যাচ্ছে। কেননা, গেল শীত মৌসুমেও তারা ভালো ব্যবসা করতে পারেনি।
 
এ বিষয়ে যাত্রাব্যক্তিত্ব মিলন কান্তি দে বাংলানিউজকে বলেন, এখনও সিরাজ-উদ-দৌলা, মাস্টার’দা সূর্য সেন, দাতা হাতেম তাই, বেবী সুলতানা, ঈশা খাঁ’র মতো পালাগুলো ভালো চলে। কিন্তু অনুমোদন কম পাওয়ায় পালা মঞ্চায়নই করা যায় না। সর্বশেষ শীত মৌসুমে হাতেগোনা কিছু পালা হয়েছে। এভাবে একটা দল টিকে থাকতে পারে না।
 
এজন্য সরকারের উচিৎ বেশি বেশি পালা করার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশাত্মবোধক পালা বা ভালো পালাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। জাতীয় যাত্রামঞ্চ প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। অন্যথায় এতো বড় একটা সাংস্কৃতিক মাধ্যম অস্তিত্ব সংকট থেকে উত্তরণ করতে পারবে না।
 
তিনি কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই বলেন, যাত্রাশিল্পীরা আজ ধুঁকে ধুঁকে জীবনযাপন করছে। অথচ তাদের টাকা পয়সার কোনোদিনও অভাব ছিল না। কয়েক হাজার শিল্পী বেকার হয়ে গেছেন।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৮
ইইউডি/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।