জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথের বয়স এখন ৭৮ ছুঁই ছুঁই। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে পারে পাকবাহিনী।
পরবর্তীতে পাক বাহিনী মীরসরাই সদর হতে অগ্রসর হয় উত্তর দিকে। তাদের লক্ষ্য, পুরো মীরসরাইয়ের দখল নেওয়া। বিশাল বাহিনী ও বহর সজ্জিত হানাদাররা যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মস্তাননগরে দুর্গ গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধারা। শুরু হয় আক্রমণ। সেখানে পাকবাহিনী এলাকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়।
এরমধ্যে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাঙালি সৈনিকরা চলে আসছিলেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা অস্ত্র চলে যাচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের হাতে। কুমিরায় ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুইয়ার নেতৃত্বে অবস্থান নেয় মুক্তিসেনারা। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ইপিআরদের সঙ্গে শুভপুর ব্রিজ মুক্তকরণ যুদ্ধে ৬-৭ জন পাক সেনা নিহত হয়। কিছুসংখ্যক সেনা ব্রিজ সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী করেরহাটে পালিয়ে যায়। ওইসময় পাকবাহিনীর অবস্থান ছিল মিরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, মিরসরাই থানা, মিরসরাই সিও অফিস এলাকায়।
যুদ্ধকালীন সময়ে মিরসরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক বাহিনীর যুদ্ধ হয়। ১০ জুন সুফিয়া এলাকায়, ১৪ জুলাই আবুতোরাব বাজারে গ্রেনেড চার্জ, ১৮ ও ২৩ জুলাই বড়তাকিয়াতে, ১১ জুলাই ফেনাপুনী ব্রীজ এলাকায় সম্মুখযুদ্ধ হয়। আবুরহাট, মিঠাছড়া, বামনসুন্দর দারোগারহাট, সাহেরখালী, খেওয়ারহাট বাজার, সোনাপুর বাজার, বাংলাবাজার, মিরসরাই সদর, মস্তাননগর-চৈতন্যের হাট, পান্থপুকুর পাড়ে পাক পেট্রোল ধ্বংস, দুর্গাপুর, করেরহাট যুদ্ধসহ মিরসরাইয়ের ছোট-বড় অনেক যুদ্ধই আছে স্মৃতি হয়ে। দীর্ঘ আট মাস ১৩ দিনের যুদ্ধে এ জনপদে প্রাণ হারান ৪২জন মুক্তিযোদ্ধা।
মিরসরাইয়ের অসংখ্য মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এদের মধ্যে মিরসরাইয়ে দুই হাজার ৬২৭ জন অংশ নেন। মিরসরাই শত্রুমুক্ত হয় ৮ ডিসেম্বর। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত মিরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সেদিন হাজারো জনতার ঢল নামে। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা মিলে সেদিন উত্তোলন করেছিলেন স্বাধীন বাংলার পতাকা।
ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরায় হরিণা যুব শিবির প্রতিষ্ঠা ও ক্যাম্প সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালনকারী মুক্তিযোদ্ধা জিতেন্দ্র প্রসাদ নাথ মন্টু বলেন, ‘স্বাধীন বাংলার বুকে যারা রাজাকারদের হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিল, যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাইরে রেখে সুবিধাভোগীদের সাজিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা-তাদের প্রতি একরাশ ঘৃণা। এ স্বাধীন দেশ তাদের নয়। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পতাকা তাদের নয়, এটা আমার-আমাদের’।
বাংলাদেশ সময়: ১০২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৮, ২০১৯
এসি/টিসি