ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত: এক ঋদ্ধ ভাণ্ডার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৮
বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত: এক ঋদ্ধ ভাণ্ডার বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত’ ১ম খণ্ডের প্রচ্ছদ

শামসুল আরেফীনের সংগ্রহ ও সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত’ ১ম খণ্ড নামে বলাকা প্রকাশন থেকে একটি গ্রন্থ বের হয়েছে। লোকসংগীতের একটি বিশাল সংগ্রহ এটি।২২ জন লোককবির প্রায় ১৬০০ গান নিয়ে এটি প্রকাশতি হয় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। রয়েছে লোককবি ও গীতিকারদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও। 

অনেক অপরিচিত অপঠিত লোকসংগীত ও লোককবিদের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে সুধিসমাজের কাছে তুলে ধরেছেন শামসুল আরেফীন। বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধকরণে লোকসংগীতের এ বিশাল ভাণ্ডারটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।

 

তার এ গ্রন্থের মাধ্যমে বিস্মৃতপ্রায় অনেক লোকসংগীত আঞ্চলিকতা ও অনালোচনার গণ্ডি পেরিয়ে ব্যপ্তি লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, ত্র গ্রন্থিতকরণে বিস্মৃতপ্রায় এ লোকসংগীতগুলো স্থিতি ও স্থায়ীত্বও পাবে।

 

লোকসংগীতের মাধ্যমে লোকায়ত মানুষের ভাব ও ভাবনারই প্রকাশ ঘটে থাকে। মানব সভ্যতার উৎপত্তির শুরু থেকেই লোকবিজ্ঞান বা লোকসংস্কৃতির উদ্ভব। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু হলেও মধ্যযুগেই লোকসংস্কৃতির প্রকৃত ক্রমবিকাশ। ভাবপ্রবণ মানুষই লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির নির্মাতা ও জনক। সমকালীন সমাজ জীবন থেকে উৎসারিত হয়েছে এ সাহিত্য এবং তা লোকমানুষের মুখে মুখে প্রবাহিত হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।  

লোকসমাজের লোক বা লোককবিদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে লোকসাহিত্য। লোকসংগীতেরও উৎপত্তি এভাবে। লোকমানুষের মুখে মুখে সংরক্ষিত হতে গিয়ে লোকসংগীতের কথা ও সুরে ঘটেছে পরিবর্তন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর উন্নত রূপও সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, লোককবিদের মৌখিক সংগীতগুলো সময় সময় লোকমুখে চলে আসা, পুনরাবৃত্তি এবং কখনো কখনো লোকমুখের পরিচর্যায় অনেক উন্নতিও লাভ করেছে।  

বর্তমান সময়ে লেখক, গবেষক, সংগ্রাহকদের উদ্ধারে এবং সংগ্রহ ও সম্পাদনায় অনেক লোকসংগীত মুদ্রিতরূপ পাওয়ায় এর পরিবর্তন পরিবর্ধনের সুযোগ রয়েছে। ‘বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত’ গ্রন্থ প্রণয়ন করে লোকসাহিত্য গবেষক শামসুল আরেফীনও এরকম একটি মহৎ কাজ করলেন। লোকসংগীত, লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতি এখন আর উপেক্ষণীয় নয় অতুলনীয়, আদরণীয়। লোকসাহিত্য মূল্যায়নে বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে এখন। শামসুল আরেফীন সে যাত্রার একজন যাত্রী। তিনি একজন পরিশ্রমী লেখক।  

এবার তার গ্রন্থে প্রবেশ করা যাক। গ্রন্থটি শুরু হয়েছে মোজহেরুল আলম ওরফে ছাহেব মিয়ার ‘জাহাঁগীরী সঙ্গীত’ দিয়ে। চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানায় জন্মগ্রহণকারী ছাহেব মিয়া ২০ শতকের লোককবি ও জাহাঁগিরিয়া নামক তরিকার শিষ্য। ‘জাহাঁগীরী সঙ্গীতে’ আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্বসহ মুর্শিদের বারমাসি গান রয়েছে। আত্মতত্ত্বের এমন একটি 
গান-
        ‘প্রেম বাজারে থেকে প্রেমের মানুষ চিনলাম না।
        চিনলে তারে প্রভু মিলে আগে জানলাম না
        শিশুকালে হাতে ধরে খেলা দিত সে অমারে।
        হেসে খেলে গেল চলে ধরতে পারলাম না
        বড় আশা ছিল মনে প্রাণ জুড়াতাম বন্ধুর সনে।
        জীবন ফুরিয়ে গেল ফিরে এলনা …’
আবার গুরুতত্ত্বের কথা তুলে ধরেছেন-
        ‘সাবধানে যাইও গো! প্রেমেরি পন্থে বন্ধু।
        গুরু বিনে কারো পানে ফিরিয়ে না চাইও গো
        প্রেম সাগরের তুফান ভারি সাবধানে দিও পারি…’
সুফি সাধক ও ভাবুক কবিদের দেশ বাংলাদেশ। এক সময় সুফি পীর-ফকির, আওলিয়া-দরবেশের ব্যাপক সমাগম ছিলো এদেশে। এদের সরাসরি প্রভাব পড়েছে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। মধ্যযুগের পুথি সাহিত্য বা মরমি গীতিকাগুলোতে নানাভাবে মরমি ভাব ও সাধনার কথা ফুটে ওঠেছে। লোককবি হেফাজতুর রাহমান খান রচিত তেমনি একটি মরমি সংগীত সংকলন ‘মুর্শিদ গীতিকা’। হেফাজতুর রাহমান খানের জন্ম চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানায় ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে। মুর্শিদ গীতিকার গানগুলোতে হেফাজতুর রাহমান খান পির-মুর্শিদের প্রতি ভক্তি ও প্রেমের বিচিত্র অনুভূতির কথা তুলে ধরেছেন।
        যেমন- হিয়ার মাঝে পিয়া এসে দেখা দিয়েছে
        রূপের ফাঁদে অরূপ বঁধু ধরা পড়েছে।
        রূপ-অরূপের প্রেমের খেলা প্রাণের মাঝে দিচ্ছে দোলা
        আর্শ বুঝি প্রেমের টানে নেমে এসেছে।
     
১৮৫৭ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার মনেয়াবাদ গ্রামে জন্ম নেন উনিশ শতকের শক্তিমান লোককবি ও গীতিকার শাহ আবদুল জলিল সিকদার। তিনিও জাহাঁগিরিয়া তরিকা ভিত্তিক অজস্র গানের গীতিকার। ‘প্রভু পরিচয়’ ও ‘শহীদে এমাম’ নামে গানের সংকলনও প্রস্তুত করেন জলিল সিকদার। তিনি পুঁথি রচয়িতাও।  

নিজ গ্রাম মনেয়াবাদ নিয়ে ‘মনেয়াবাদের ইতিবৃত্ত’ ও জাহাঁগিরিয়া তরিকার পির গৌছ জাহাঁগিরকে নিয়ে ‘জাহাঁগীর চরিত’ নামে পুথিদ্বয় রচনা করেন। এর একটি পাণ্ডুলিপি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য শাখায় ‘জাহাঁগীর চরিত ও বারমাসী’ নামে সংরক্ষিত রয়েছে। শামসুল আরেফীন তার গ্রন্থে এ পুঁথিটি পত্রস্থ করেছেন। পুঁথিটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, সরস ও সুপাঠ্য।  

উনিশ শতকের শেষ দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার মন্দাকিনী গ্রামে জন্মেন মাওলানা বজলুল করিম মন্দাকিনী। মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রবর্তক হযরত আহমদুল্লাহর শিষ্য ও খলিফা মাওলানা বজলুল করিম অনেক গান রচনা করেন। তার গানের সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘প্রেমের হেম’, ‘প্রেমাঞ্জলী’ ও ‘শেষ জীবন’ প্রভৃতি। ‘শেষ জীবন’ ও ‘প্রেমাঞ্জলী’  সংকলনদ্বয় শামসুল আরেফীনের এ গ্রন্থভুক্ত হয়েছে।  

বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক প্রভাংশু ত্রিপুরার সঙ্গে লোকগবেষক শামসুল আরেফীনচট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার মাইজভাণ্ডারী গানের গীতিকার কাজল শীলের ‘হিয়ার মধ্যমণি’ নামে একটি গানের সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে। গানগুলোর বেশিরভাগই মাইজভাণ্ডরী পীর সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার শাহের শানে রচিত। কাজল শীলের  এরূপ একটি গান উদ্ধৃত করছি-‘খলিলুল্লাহ মাইজভাণ্ডারী প্রেমের মহাজন।
        নিত্য তাহার প্রেমবাজারে প্রেম হয় অর্পন
        মন কেন রে কর দেরী, ভাণ্ডারে যাও তাড়াতাড়ি,
        বখতপুরে সাজায়েছে নূরের সিংহাসন…’

‘খলিলুল্লাহর পুষ্পকুঞ্জ’ নামে শেখ নিজাম উদ্দিনের গানের একটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। নিজাম উদ্দিনের জন্ম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানায়। মাইজভাণ্ডারী দর্শনের মানসপুত্র হযরত সৈয়দ নুরুল বখতেয়া শাহের শান-মানে লিখিত হয়েছে গানগুলো। এ গানগুলোর মধ্য দিয়ে মূলত নিজাম উদ্দিনের আধ্যাত্মিক ভাব ও চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।  

শামসুল আরেফীন তার গ্রন্থে আবদুল গফুর হালীর দুটি গানের সংকলন ‘তত্ত্ববিধি’ ও ‘জ্ঞানজ্যোতি’ পত্রস্থ করেছেন। আবদুল গফুর হালী একাধারে আঞ্চলিক, মাইজভাণ্ডারী, মুর্শিদি, মারফতি প্রভৃতি গানের গীতিকার ও সুরকার।  

‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান’ গ্রন্থের সংকলক ও সম্পাদক কল্যাণী ঘোষ গ্রন্থটিতে গফুর হালীর সংগীত জীবনের সূচনার কথা জানান, ‘আবদুল গফুর হালী যখন সঙ্গীত চর্চা করতেন সে সময়ে বিশেষ করে মুসলিম ছেলেদের জন্য সামাজিকভাবে গান-বাজনা নিষিদ্ধ ছিল। খুব কষ্ট করে পরিশ্রম করে সঙ্গীত জগতে তাকে আসতে হয়েছে। পিতা মরহুম আবদুল সোবহান ছিলেন একেবারে সুফি ঘরানার মানুষ এবং মা গুলতাজ খাতুন ছিলেন পর্দানশীল নারী। সুতরাং ওই সমাজে তখন গান-বাজনার প্রশ্নই আসে না।  

তিনি বলেন, তখন ব্রিটিশ শাসন সমাপ্তির দিকে, ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ আর চারদিকে চলছে যুদ্ধ। গ্রামেও শান্তি নাই। এক বছরের স্কুলের বেতন ২৪ টাকা দিতে না পারায় ষষ্ঠ ক্লাস পর্যন্ত পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হলো। তারপর শুরু হলো তার লেখালেখি জীবন। তার মনের সব দুঃখ কষ্ট ওই লেখায় প্রকাশ করার চেষ্টা করতেন। এভাবে লিখতে লিখতে ৫৫/৫৬ সালের দিকে গান লেখা শুরু করলেন। ’

গফুর হালী মধ্যযুগের লোককবি ও পুঁথিকারক আস্কর আলী পণ্ডিতের একজন ভাবশিষ্য। এ পর্যন্ত দু’হাজারের অধিক গান তিনি রচনা করেছেন। আবদুল গফুর হালীর জন্ম ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে (বর্তমানে ১৯২৯ ও ১৯২৮ লেখা হয়) চট্টগ্রামের পটিয়া থানার রশিদাবাদ গ্রামে। ‘তত্ত্ববিধি’-তে গ্রন্থিত হালীর মরমি গানগুলো অত্যন্ত উঁচুমানের। অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা হালীর দুটি গান উদ্ধৃত করছি-
‘আর কতদিন খেলবি খেলা মরণ কি তোর হবেনা/ আইল কত গেল কত কোথায় তাদের ঠিকানা /ওমর ওসমান হযরত আলী রসুলুল্লা গেল চলি/আদম হইতে এই পর্য্যন্ত ফিরে ত কেউ আইল না …’
        
এবং
        জিলা চট্টগ্রাম রে বার আউলিয়ার স্থান,
        এই দেশেতে জন্ম কত আউলিয়া মস্তান রে
        বার আউলিয়ার স্থান।
        শাহ বদর জ্বালাই বাতি ধাইয়া গেল দানব জাতি,
        চাঁটি দিয়া আবাদ করি চাটগাঁ হইল নাম রে
        হযরত বায়েজিদ বোস্তামী
        খোদার প্রেমিক ছিলেন তিনি,
        নাছিরাবাদ পাহাড়েতে আসন তার প্রমাণ রে
        চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী
        হযরত কেবলা আহমদ উল্লা, বাবা রহমান রে
        সহর কুবুত শাহ আমানত করিতে তার জেয়ারত
        শত শত ভক্ত আসি পুরায় মনষ্কাম রে
        পীর বুজুর্গ নিয়া জন্ম চট্টগ্রাম করিল ধন্য
        তাঁদেরি চরণে জানাই হাজারো সালাম রে
চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী লৌকিক তরিকা মাইজভাণ্ডারী প্রচার করলে এর জনপ্রিয়তা এতদঞ্চলসহ সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ে। খুব কম সংখ্যক ছাড়া চট্টগ্রামের সমকালিন বা পরবর্তী প্রায় সব লোককবি সাহিত্যিক সংগীতজ্ঞদের প্রভাবিত করে এ তরিকা। এর ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে।  
         
‘পঞ্চরত্ন গীতিকা’ নামে মো. আবদুল জব্বার শাহ মিমনগরীর অনেকগুলো গান গ্রন্থিত আছে গ্রন্থটিতে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে কিশোরগঞ্জের মিমনগরে জন্ম আবদুল জব্বার শাহ মিমনগরীর। মিমনগরী মাইজভাণ্ডারী গানের গীতিকার এবং তিনি গোলামুর রহমান ভাণ্ডারীর শিষ্য। তার গানগুলো আরবি ফারসি ভাষার বিভিন্ন আলঙ্কারিক সৌন্দর্যেও সমৃদ্ধ।
 
ফকির ইয়াছিন শাহ দু’হাজারেরও অধিক গান ও গজল রচনা করেছেন। তার গান ও গজলে বাউল-সুফি-বৈষ্ণব তত্ত্বের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। বাউলরা যেভাবে নিজের মনের মানুষকে প্রতীকায়িত করেছেন ‘অধর মানুষ, অটল মানুষ, অলক সাঁই, অচিন পাখি, মনোরাজা রূপে’ ইয়াছিন শাহের গান ও গজলেও রয়েছে কালিয়া, কানাই রাধিকা, শ্যাম, গোপিনী প্রভৃতি রূপকের ব্যবহার।  
    যেমন-দমকলেতে বাজে বাশী কদম্বতলায়
        আনন্দে গোপিনী লইয়া নাচে রাধিকায়।
        আয় গো ধ্বনী প্রাণসজনী,
        আয় গো তোরা আয়।
        হে গো, কদমতলে বাজায় বাশী,
        বাক্কা শ্যামরায় গো।  
        বাজে বাশী কুল বিনাশী, ডাকছে কোকিলায়।
        বিপিন বনে মৃগে নাচে, নাচে ময়ুরায় গো।
        (দম কলেতে)
এছাড়াও গ্রন্থটিতে পত্রস্থ হয়েছে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার ফকির বাবর চৌধুরী, বিশ্বনাথ উপজেলার আবদুস সবুর মাখন, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের শহীদ সাগ্নিক, মীর লিয়াকত, চট্টগ্রামের চন্দনাইশের মোহাম্মদ বাদশাহ আলমদের বেশ কিছু গান। শহীদ সাগ্নিকের এমন একটি গানে সৎ মানুষের সঙ্গ নেওয়া এবং আত্মশুদ্ধির আহ্বান। যেমন- ‘ও ভাই বেরাদর বহিন বেরাদর/মনটারে তোর শুদ্ধ ছাফা কর/মন বিশুদ্ধ না হলে তোর শুদ্ধ হয়না দেহঘর/সৎভাবনায় থাকলে পরে বাড়বেরে তোর মনের জোর/    সুচেতনার সুবাতাসে ভয় ভাবনা হবে দূর…’

শামসুল আরেফীন তার লোকসংগীত গ্রন্থে ‘মেঘনা নদীর ভাঙনে হাতিয়া দ্বীপের করুণ কাহিনী’ নামক একটি দীর্ঘ গীতিকবিতা পত্রস্থ করেছেন। গীতিকবিতাটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপের লোককবি আব্দুর রশিদের লেখা।  
 
হাজার বছর ধরে কতোশতো গুণী মনীষীর উর্বর চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ হলো আমাদের লোকসংগীতগুলো। এগুলোর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধকরণের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। আরেফীনের সংগৃহীত লোকসংগীতের এ বিপুল ভাণ্ডারটিও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্রন্থটি সুধিসমাজের কাজে লাগবে।  

জানা মতে, লোকসাহিত্য বিষয়ক আরেফীনের অন্যান্য গ্রন্থও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কুড়িয়েছে। লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায় তার ব্যাপক কাজ রয়েছে। লোকসাহিত্য বিষয়ে ইতোমধ্যে আরেফীনের অনেকগুলো গ্রন্থও প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে- আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায়-২০০৬, বাংলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য ১ম খণ্ড-২০০৭, বাংলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য ২য়-৪র্থ খণ্ড-২০০৮, আস্কর আলী পণ্ডিতের দুর্লভ পুঁথি জ্ঞান চৌতিসা ও পঞ্চসতী প্যারজান-২০১০ (সম্পাদনা) উল্লেখযোগ্য।  

শামসুল আরেফীন মাঠ পর্যায়ে ফোকলোর চর্চার একজন একনিষ্ঠ কর্মী, উদ্ধারকর্মী সর্বোপরি পায়ে হাঁটা পরিশ্রমী যুবক। যেখানে আমাদের নগরবাসী ডিগ্রিধারী গবেষকদের প্রায় অনেকেই মাঠ পর্যায়ের ফোকলোর কর্মীর কর্মকাণ্ডকে হেয় চোখে দেখে আসছেন। এখনো কারো কারো মানসিকতায় এর ছিটেফোঁটা রয়ে গেছে। অথচ ফোকলোর চর্চায় শহরবাসীদের তথ্য-উপাত্তে অনেক ফাঁকফোকর থেকে যায়। মাঠ পর্যায়ের কর্মকাণ্ডের খাঁটিত্ব সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ অনেক সময় কম থাকে।  

এদিক বিবেচনায় লোকসাহিত্য ও লোকসংগীতের সংগ্রাহক হিসেবে শামসুল আরেফীনের অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আমরা আশাবাদী প্রজন্মের এ তরুণ গবেষক ও সংগ্রাহক তার প্রচেষ্টায় লোকসাহিত্যকে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত তথ্য ও উপাত্তের নিরিখে মৌলিক বিষয়রূপে সুধিমহলের কাছে উপস্থিত করবেন।    

লেখক: জয়নাল আবেদীন শিবু: যুগ্ম আহ্বায়ক, কবিতাবাংলা, মৌলভীবাজার। নির্বাহী সম্পাদক: লেখাবিল 

বাংলাদেশ সময়: ২০২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।