ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে দেশ ছেড়েছিলাম’

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৮
‘বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে দেশ ছেড়েছিলাম’ ভারত-প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা অমলেন্দু সরকার। ছবি: সোহেল সরওয়ার

চট্টগ্রাম: জীবনের সব কিছু দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার যে বঙ্গবন্ধুকে মারতে সাহস করেনি তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে এদেশের মীরজাফররা। এর থেকে বড় দুঃখ বাঙালির আর কী হতে পারে। বাঙালির কান্নার রোল আজ না হোক, ১০০ বছর পরে হলেও উঠবে। আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে দেশ ছেড়েছিলাম।   

চট্টলবীর খ্যাত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহচর, ভারত-প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা অমলেন্দু সরকার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে বাংলানিউজকে এসব কথা বলেন।

আরও পড়ুন>>
** 
দুই বীরের বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদের স্মৃতিগাথা

তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৩ আগস্ট থেকে চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, কমান্ডার আবুল হাসেম, প্রয়াত সন্তোষ ধর, সুলতানুল কবির চৌধুরী, সীতাকুণ্ডের জিতেন্দ্র প্রসাদ মন্টুসহ আমরা ঢাকায় ছিলাম।

আমাদের প্ল্যান ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করব। আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার।
তোপখানা মোড়ের সম্রাট হোটেলে আমরা অবস্থান করছিলাম। ১৫ আগস্ট ভোররাত চারটার দিকে দারোয়ান এসে দরজায় নক করে বলল, স্যার রাস্তায় মিলিটারি ট্যাংক নেমে গেছে। আমি মহিউদ্দিন ভাইকে ডেকে তুললাম। মেইন রোডে গেলাম। দেখলাম চারখানা ট্যাংক, জিপ, উইথ পদাতিক বাহিনী। শাপলা চত্বরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তখন পৌনে পাঁচটা। আমরা মনে করেছিলাম, ক্যু হয়ে গেল।

ফিরে এলাম হোটেলে। সকাল নয়টায় আবার বের হলাম। সুলতান ভাই অসুস্থ থাকায় বের হননি। আমরা প্রথমে গেলাম পিজি হাসপাতালে। বেলা ১১টার দিকে পিজি হাসপাতালে একটি ভ্যানে করে মণি ভাই ও তার স্ত্রীর মরদেহ আনা হলো। তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তখন কিন্তু ঢাকা শহরে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার খবর চাউর হয়ে যায়। মরদেহগুলো আসার পর মিলিটারি ঘিরে ফেলে পুরো হাসপাতাল। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।

মুক্তিযোদ্ধ‍া অমলেন্দু সরক‍ার।  ছবি: সোহেল সরওয়ারআমরা বেরিয়ে এলাম। মিন্টু রোডে গেলাম। প্রথমে গেলাম ফণীভূষণ মজুমদারের বাসায়। তিনি বললেন, ভাসা ভাসা খবর পাচ্ছি। আসল ঘটনা বুঝে আসছে না। ভালো হয় তোমরা যদি চট্টগ্রামে ফিরে যাও।

এরপর আমরা গেলাম ডাক ও তার মন্ত্রী একেএম ওবায়দুর রহমানের বাসায়। উনি ছিলেন খুবই নেগেটিভ। টেলিফোনে নানা জনকে নির্দেশনা দিচ্ছেন। অবস্থা সুবিধার মনে না হওয়ায় আমরা বেরিয়ে এলাম।

গেলাম মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বাসায়। অনেক ছাত্র-জনতা। কিন্তু তোফায়েল আহমেদ নেই। মহিউদ্দিন ভাই চেয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদকে দিয়ে একটি বিবৃতি দেওয়ার জন্য। যাতে ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মনসুর আলীর বাড়ির পাশ দিয়ে আসার পথে দেখলাম মিন্টু রোড ক্রমে মিলিটারি ঘিরে ফেলছে। তখন কিন্তু ঢাকা শহরের অনেক সড়কে লোকজন নেমে গেছে। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক, উদ্বেগ। দেখলাম এলিফ্যান্ট রোডে মোস্তফা মহসিন মন্টুর নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের হলো। আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। তখন আড়াইটা বাজে। আমরা সম্রাট ছেড়ে কমলাপুরে চলে এলাম। সেখানে কোনো ট্রেন নেই। রেললাইন ধরে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন। সেখানে একটি মালগাড়িতে ১৭ আগস্ট চট্টগ্রাম ফিরি।   

মহিউদ্দিন ভাই সবাইকে ডাকলেন। যুবলীগ চেয়ারম্যান হাজি কামাল, মান্নান ভাই, ইসহাক ভাই, লেখক ইদ্রিস আলম, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইদ্রিস আলম, হাজারী লেনের শ্রমিক নেতা মো. জামালকে নিয়ে দুই দিন মিছিল-মিটিং করলেন। ২২ আগস্ট চট্টগ্রামে ধরপাকড় শুরু হলো। তখন জেলা প্রশাসক ছিলেন এবি চৌধুরী। পুলিশ কমিশনার ছিলেন মি. জামান। মাসুদুর রহমান নামের একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ছিলেন। সবার সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। আমরা লালদীঘির পাড়ের নান্টু বাবুর সরোজনী ফার্মেসিতে বসতাম। সেখানে মাসুদুর রহমান খবর দিয়ে গেলেন, অমল মিত্র, সন্তোষ, মহিউদ্দিন, অমলেন্দু, সুলতান ভাইসহ কয়েকজনের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে। এসপি অফিসে দেখে এসেছেন। উনারা যেন শহর ছেড়ে চলে যান। নান্টু বাবু সবাইকে খবর দিলেন।

আমি ঘাটফরহাদবেগে থাকতাম। বিকেল পাঁচটায় দেখলাম মিলিটারি জিপ ঢুকছে। আমি পালিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সন্তোষ ধরকে বার্তা দিলাম। মাসুদুর রহমান তখন পুলিশ লাইনের বিপরীতে থাকতেন। উনার পরিবার কুমিল্লা যাচ্ছিলেন জিপে। সেই জিপে করে রাতে পাঠিয়ে দিলেন। দুই দিন কুমিল্লা ছিলাম। পকেটে তখন ২৬ টাকা ছিল। এরপর ঢাকা গেলাম। আমার পকেটে একটি পাসপোর্ট ছিল, ডাক নাম ‘ঝুন্টু সরকার’ দিয়ে সেটি তৈরি করেছিলাম। যুবলীগ থেকে রাশিয়া যাওয়ার জন্য সেটি করা হয়েছিল। ফণীদার বাসায় উঠলাম। উনি তখন পিজিতে ভর্তি হয়ে গেছেন। উনার পিএ বললেন, আপনাকে ভারতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। পাসপোর্ট-টিকিট দেওয়া হবে। পুরাতন এয়ারপোর্টে চলে যাবে।

আমি যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম তখন দেখলাম আর্মি জিপ হাজির। তাদের কাছে থাকা লিস্ট অনুযায়ী সবাইকে চেক করছে। কিন্তু ডাক নামে পাসপোর্ট থাকায় বেঁচে গেলাম। তবুও জানতে চাইল, কেন ঢাকা থেকে যাচ্ছি। বললাম, মা খুব অসুস্থ। আমি ঢাকায় থাকতাম। মাকে দেখতে যাচ্ছি। ফ্লাইটে ওঠার পর দেখলাম আর্মি জিপে মোস্তফা মহসিন মন্টুকে পৌঁছে দিল বিমানবন্দরে। তিনিও একই ফ্লাইটে কলকাতা গেলেন।  

আমাদের প্রিজনভ্যানে নিয়ে যাওয়া হলো কলকাতার এমএলএ গেস্ট হাউসে। আস্তে আস্তে নাসিম ভাই, আবুল হাসনাত, শেখ সেলিমসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা এলেন। দেশে ধরপাকড় শুরু হওয়ায় এক মাসের মধ্যে কলকাতায় আশ্রয় নিল ৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হলো বিভিন্ন ক্যাম্পে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রামকে আলাদা করে দেওয়ার। এরপর অনেক কষ্ট করেছি।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের দাবি জানিয়ে অমলেন্দু সরকার বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা মীরজাফর। তখন তাদের বয়স ছিল ৩০-৩২ বছর। নির্মম হত্যাকাণ্ডের এতগুলো বছর পরও তাদের ফাঁসি না হলে হবে কখন?

বাংলাদেশ সময়: ১১১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৮
এআর/টিসি

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।