ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

স্বাধীনতার ‘ঘোষণা’ যে বেতার কেন্দ্রে সেটি এখন নিঃস্ব!

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮
স্বাধীনতার ‘ঘোষণা’ যে বেতার কেন্দ্রে সেটি এখন নিঃস্ব! কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ১০৩ নম্বর কক্ষ যেখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচারিত হয়েছিল। ছবি: উজ্জ্বল ধর / বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: স্বাধীনতার ঘোষণা যে বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম এবং বার বার প্রচারিত হয়েছিল সেটি এখন নিঃস্ব। একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ যে কক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল তা কোনো রকমে টিকে থাকলেও নেই তখনকার যন্ত্রপাতি, মাইক্রোফোন, চেয়ার। এসব জাতীয় সম্পদ এখন শোভা বাড়াচ্ছে একটি ব্যক্তিক জাদুঘরে।  

চার যুগেও স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র তথা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রকে ঘিরে তৈরি হয়নি জাদুঘর, সংগ্রহশালা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ কমপ্লেক্স। ফলে তরুণ প্রজন্ম জানতে পারছে না সঠিক ইতিহাস।

আবার ব্যক্তিক জাদুঘরটিতে এমনভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার যন্ত্রপাতি উপস্থাপিত হচ্ছে যা তরুণ, শিশু-কিশোরদের ভুল বার্তা দিচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের।

শনিবার (২৪ মার্চ) দুপুরে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল সংলগ্ন বেতার কেন্দ্রটি সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ১০৩ নম্বর কক্ষের ভেতর বাংলায় লাল হরফে লেখা আছে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা কক্ষ’। নিচে ইংরেজিতে লেখা ‘ডিকলারেশন অব ইনডিপেনডেন্স অন-এয়ার ফর্ম হিয়ার’। ধুলোবালিতে একাকার একটি টেবিলের ওপর ভাঙাচোরা কিছু যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। পাশে পড়ে আছে হাল আমলের একটি চেয়ার। দেয়ালের রং খসে পড়ছে। কক্ষের দরজার ওপর ছাদে খসে পড়ছে পলেস্তারা। দেখা যাচ্ছে লোহার রড।

এ মাইক্রোফোন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার করা হয়।   জিয়া স্মৃতি জাদুঘরে এটি সংরক্ষিত আছে।   ছবি: উজ্জ্বল ধর

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকলেও এ কেন্দ্রের ফটকসহ আশপাশে কোথাও চোখে পড়েনি কোনো স্মৃতিফলক, ভাস্কর্য, স্থাপনা, ম্যুরাল, দেয়ালচিত্র ইত্যাদি কিছুই। তালাবদ্ধ ১০৩ নম্বর কক্ষের ভেতর ছাড়া বাইর থেকে বোঝার উপায় নেই এ বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল।     

বাংলাদেশ বেতারের আবাসিক প্রকৌশলী মো. মোজাফফর হোসেন বাংলানিউজকে জানান, দেশ স্বাধীনের পরও এ কেন্দ্রের অধীনে ২৭ একর জায়গা ছিল। বিএনপি সরকারের আমলে বেতার কেন্দ্রের জন্য ৯ দশমিক ৩৬ একর জমি রেখে বাকিগুলো স্বাধীনতা পার্কের জন্য নিয়ে নেওয়া হয়।

তিনি জানান, বর্তমানে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ১০০ কিলোওয়াটে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। আগ্রাবাদ স্টেশনে অডিও সিগন্যাল জেনারেট করা হয়। এরপর মানুষের কাছে পৌঁছানোর ৯৮ ভাগ কাজই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে একজন এসআইসহ পুলিশ সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট চট্টগ্রামের মহাসচিব ফাহিমউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি যতদূর জানি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যে চেয়ারে বসে যে মাইক্রোফোন ও ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতির সাহায্যে এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্প্রচার করেছিলেন তা ব্যক্তিক জাদুঘর তথা পুরোনো সার্কিট হাউস হিসেবে পরিচিত জিয়া স্মৃতি জাদুঘরে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যা দেখে তরুণরা মনে করতে পারে, বিভ্রান্ত হতে পারে জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক। এটা দুঃখজনক।  

জিয়া স্মৃতি জাদুঘরে রাখা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ঐতিহাসিক ট্রান্সমিটার।   ছবি: উজ্জ্বল ধর

তিনি অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের সব আসল চেয়ার, টেবিল, মাইক্রোফোন ও ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি ব্যক্তিক জাদুঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে সংরক্ষণ ও সাধারণ মানুষের দেখার জন্য উন্মুক্ত জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চট্টগ্রাম মহানগর কমান্ডার মোজাফফর আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে সুকৌশলে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রকে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা পার্কের নামে থিম পার্ক করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের তিন ভাগের দুই ভাগ জায়গা নিয়ে নিয়েছে। একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ এমএ হান্নান প্রথম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এ কেন্দ্রে যে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ব্যবহার করে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন সেগুলো জিয়া জাদুঘরে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে। আমাদের দাবি থাকবে এসব যন্ত্রপাতি দ্রুত সরিয়ে নিয়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হোক। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও এমএ হান্নানের ভাস্কর্য করা হোক। এ বেতার কেন্দ্রের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস শ্বেতপাথরে লেখা হোক। এটি হবে সারা দেশের মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।  

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের স্বাধীনতার ঘোষণা কক্ষের দরজার ছাদের জীর্ণশীর্ণ দশা।   টেবিলের ওপর পড়ে আছে কিছু যন্ত্রপাতিও

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সাহাবউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর করা হোক। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে এ কেন্দ্রকে পঙ্গ‍ু করে দেওয়া হয়েছে। এ কেন্দ্রের জায়গা যেমন পার্কের নামে বেহাত হয়েছে তেমনি ব্যক্তি জাদুঘরে স্বাধীনতা ঘোষণার মহামূল্যবান যন্ত্রপাতি পাচার করা হয়েছে। যা আমাদের জন্য লজ্জার। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাব, স্বাধীনতা ঘোষণা সম্প্রচারের সঙ্গে জড়িত বেতার কেন্দ্রটিকে ঘিরে বড় কিছু করতে হবে যাতে ইতিহাস বিকৃতির কবর রচনা হয় এবং দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে পরিচালিত ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, চট্টগ্রাম’ ঘুরে দেখা গেছে নিচতলার ২ নম্বর গ্যালারিতে ‘ডিওরামা’ ঘোষণা পাঠরত জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্যের সঙ্গে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের সেই মাইক্রোফোন, রেডিও কনসোল, টেবিল, ঘূর্ণায়মাণ চেয়ার রাখা হয়েছে। যাতে লেখা রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠরত মেজর জিয়া ২৭ মার্চ ১৯৭১। ’

পাশের শোকেসে রাখা হয়েছে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ঐতিহাসিক ট্রান্সমিটার। যাতে লেখা আছে ‘এ যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয়েছিল। সৌজন্য: বাংলাদেশ বেতার। ’ পাশে দেয়ালে টাঙানো আছে ‘কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ঐতিহাসিক ট্রান্সমিটার’র ছবি। মেজর জিয়ার ঘোষণা পাঠরত অবস্থায় একটি বড় তৈলচিত্র। আরেকটি ছোট আলোকচিত্র আছে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের। যার পরিচিতিতে আছে ‘চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র যেখান থেকে ২৬ হতে ৩০ মার্চ ’৭১ বার বার সম্প্রচারিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। ’

মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি প্রসঙ্গে জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের ব্যবস্থাপক মো. মতিয়ার রহমান বাংলানিউজকে বলেন, জাদুঘর হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। কালুরঘাটে নতুন জাদুঘর তৈরি করাটা এবং সেখানে স্বাধীনতা ঘোষণা সম্প্রচারের যন্ত্রপাতি স্থানান্তর করাটা সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৮ 

এআর/টিসি

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।