ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

প্রতিষ্ঠিত নারীই সব নারীর মাপকাঠি নয়

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৪ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৮
প্রতিষ্ঠিত নারীই সব নারীর মাপকাঠি নয় ডা. সাহানারা চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী ও শিল্পী সোমঋতা মল্লিক

চট্টগ্রাম: প্রতিষ্ঠিত নারীরাই দেশের সব নারীর মাপকাঠি হতে পারে না বলে মনে করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগের প্রধান ডা. সাহানারা চৌধুরী।

তিনি বলেন, ১৩১৩ শয্যার এ হাসপাতালে আমরা বেশিরভাগই গরিব রোগী দেখি। এমন নারীও পাই যারা কোনো দিন স্বাস্থ্যবার্তাই শোনেনি।

আবার যখন আমরা সন্ধ্যায় প্রাইভেট চেম্বারে বসি তখন শিক্ষিত, সচ্ছল, বিত্তশালী নারীদের দেখি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
এ জন্যই প্রতিষ্ঠিত নারীরাই মাপকাঠি হতে পারে না। তবে তাদের নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। তারা আলোর দিশারি।  

তার মতে, কিশোরী-স্কুলছাত্রী এমনকি শিশুরা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যা লজ্জার। মোড়ে মোড়ে বখাটেদের উৎপাত বেড়েছে, ইভটিজিংয়ের ঘটনা অহরহ ঘটছে। গণপরিবহনে নারীর ঝুঁকি বাড়ছে, উত্ত্যক্ত হচ্ছে। এখনো সমাজে নারী শ্রমিকদের মজুরি কম, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। রাত-বিরাতে চলাফেরায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি কাটেনি। কিশোরীদের স্বাস্থ্যবার্তা, স্বাস্থ্য সচেতনতা নিশ্চিত করা যায়নি। তাই চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।  

চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিয়ের আগে ভাই, বাবা, চাচা এবং বিয়ের পর স্বামীকে পথ দেখাতে হবে নারীকে। নারী জাগরণে পুরুষদের সহযোগিতা লাগবে। নারীকে অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে সুযোগ করে দিতে হবে। সেবার ক্ষেত্রে নারীদের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক। মাতৃত্ব থেকে সেবা। সেবা থেকে নার্সিং। মেয়েদের সেবা আন্তরিক, মর্মস্পর্শী। তাই স্বাস্থ্যখাতে সেবিকাদের ভূমিকা বেশি।      

তিনি বলেন, বেগম রোকেয়া নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছেন। তখন নারীদের পড়াশোনার চ্যালেঞ্জ ছিল। দিন দিন এটা সহজতর হয়েছে। স্বাধীনতার পর রক্ষণশীলতার চাদর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকেন নারীরা। এখন আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি তৈরি পোশাক খাত, শিক্ষকতা, চিকিৎসাসেবায় বড় অংশটি নারী। আমি মনে করি, নারীরা অগ্রগামী। তারা কর্তব্যপরায়ণ। তাদের মধ্যে এগিয়ে যাবার স্পৃহা আছে। এটা সরলীকরণ করা উচিত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। নারী জাগরণই দেশের ভবিষ্যৎ।      

তিনি বলেন, চমেকে ভর্তি হই ১৯৮৪। তখন ২০ শতাংশ ছিল ছাত্রী। মেডিকেলে এখন ৭০-৮০ শতাংশ ছাত্রী। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার এখন স্বীকৃত। নারী জাগরণের মূলমন্ত্র শিক্ষা। আগে অষ্টম শ্রেণি পাস করলে বিয়ের ধুম পড়ত। এক নারী শিক্ষিত হওয়া মানে ১০ নারী শিক্ষিত হওয়া। ১০ নারী শিক্ষিত হওয়া মানে ১০০ নারী শিক্ষিত হওয়া।

আমি মেয়ে তাই আমি গর্বিত!

সুচিন্তা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট জিনাত সোহানা চৌধুরী মনে করেন, মেয়েরা ছাড়া মানুষ শব্দটিই অসম্পূর্ণ। মেয়েরাই আজ পুরুষের কাঁধে হাত রেখে সমান তালে এগিয়ে চলছে দুর্বার গতিতে! আমি মেয়ে তাই আমি গর্বিত! ছেলেদের সমান নয়, আমি মানুষের উচ্চতায় উঠতে চাই।

নারীর ক্ষমতায়ন, সমসুযোগ, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

রাজনীতিতে নারীর সম্পৃক্তায়ন নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম ধাপ। বিশ্ব রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান আজ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটি একদিকে যেমন নারী জাতির অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ, তেমনি নারীর ক্ষমতায়নের বিশেষ দিক। পৃথিবীর পরিবর্তনে তথা উন্নয়নের ধারায় আজ নারীদের অবস্থান সর্বস্তরে। রাজনীতিতে তাদের প্রবেশাধিকার নারীদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যুগ যুগ ধরেই নারীদের নিজ প্রতিভাবলে বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ হয়েছে এবং এর ইতিবাচক দিক হলো এটি ক্রমবর্ধমান।

বর্তমান সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও নেতৃত্বে নারী উন্নয়ন আজ দৃশ্যমান। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করায় নারীর ক্ষমতায়নে শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর বড় ভূমিকা রয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কতটা হচ্ছে, আইনগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়মিতভাবে তদারক করা প্রয়োজন। নারী নির্যাতন মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি না, তা তদারক করা ও জবাবদিহির বিষয়টি খুবই দরকার।

বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা ১৬ কোটির ওপরে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী। তাই এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষর, অবহেলিত ও অদক্ষতায় পেছনে রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। পাশাপাশি সমাজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীদের অবস্থান দৃঢ় হয়। পরিবারে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারেন। দরকার নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করা।

বর্তমান সরকার ই-কমার্স ও ই-মার্কেটে দেশের নারী সমাজের সক্ষমতাকে যুক্ত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে-যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ঊর্ধ্বমুখী করবে। তথ্যপ্রযুক্তিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।

নারীকে মানুষ হিসেবেই দেখতে হবে, নারী হিসেবে নয়। সব ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ ও কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে তবেই জাতীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে বাংলাদেশ হবে সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক ও উন্নত ডিজিটাল বাংলাদেশ।

জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা

ওপার বাংলার নজরুলসংগীত শিল্পী সোমঋতা মল্লিক বাংলানিউজকে বলেন, নারীদের নিয়ে বছরে একটি দিন নয়। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নারীদের গুরুত্ব দিতে হবে। এখনো নারীরা লাঞ্ছনার শিকার হন। বঞ্চনার শিকার হন। নারীমুক্তির জন্য নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে।

নজরুল বলেছেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই! বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। ’

সোমঋতা বলেন, নারী জাগলে সমাজ পরিবর্তন হবে, দেশ পরিবর্তন হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৮

এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।