ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

মানুষের ছবি তুলতেই বেশি পছন্দ তাপস বড়ুয়ার

আল রাহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮
মানুষের ছবি তুলতেই বেশি পছন্দ তাপস বড়ুয়ার আলোকচিত্র সাংবাদিক তাপস বড়ুয়া। ছবি: সোহেল সরওয়ার, বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: আশির দশকে চট্টগ্রামে দাপটের সঙ্গে আলোকচিত্র সাংবাদিকতা করেছিলেন তাপস বড়ুয়া। ২০০৩ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। কয়েকদিন আগে দেশে ফিরেছেন। শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) শুরু হচ্ছে তার পঞ্চম প্রদর্শনী ‘বিউটি অব বোস্টন’। তার সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন বাংলানিউজের ব্যুরো এডিটর তপন চক্রবর্তী।

প্রথম ছবি ‘স্নেহ বৈরিতা মানে না’

ছোটবেলা থেকে ছবি তুলতাম। একদিন মামার বাড়িতে দেখলাম কুকুর ও বিড়ালের অন্তরঙ্গতা।

কুকুরের বুকে বিড়াল বসে আছে। ওই ছবি তুলে প্রিন্ট করলাম।
সবাইকে দেখাই। প্রশংসা পাই। একদিন সাহস করে দৈনিক আজাদী কার্যালয়ে যাই। সাধন ধর, ওবায়দুল হকসহ সিনিয়র সাংবাদিকরা বসা। ছবিটি দেখালাম। বললেন রেখে যেতে। তারপর দুই-তিন দিন কাগজ দেখি। ছবি উঠেনি। তারপর একদিন প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে ছাপানো হলো সেই ছবি। ‘স্নেহ বৈরিতা মানে না’ শিরোনাম। এরপর কাগজে কাজ করাটা নেশা হয়ে গেল।

তখন ছবির মান ভালো হতো না

তখন কাগজ ছাপানো হতো হ্যান্ড কম্পোজে, সিসার টাইপে। ছবি ছাপানোর আগে ডায়াস তৈরি করতে হতো। কোয়ালিটি যেমন থাকত না তেমনি আকারেও ছোট হতো। ফ্লিমে ছবি তোলার পর টেনশন কাজ করত ঠিকভাবে ছবি উঠেছে তো! যত দ্রুত সম্ভব আমরা ডার্করুমে গিয়ে নেগেটিভ বের করার চেষ্টা করতাম। এরপর শান্তি। ঢাকায় যখন ক্রিকেট হতো, দু-তিনটি ওভার কাভার করে ছুটতাম বাস টার্মিনালে। ড্রাইভার বা পরিচিত কাউকে দিয়ে চট্টগ্রামে পাঠাতাম ফ্লিম। তারপর পিয়ন সেটি বুঝে নিয়ে ডেভেলপ করত। এখন তো ডিজিটাল বাংলাদেশের মাঠে বসেই ছবি পাঠানো যাচ্ছে।

ধর্ষিতা সীমা হারিযে যেত!

আমাকে আর হেলাল ভাইকে পেজার দিয়েছিল আজাদী কর্তৃপক্ষ। সব খবর চলে আসত সেখানে। তখন রাউজানে পুলিশের হাতে সীমা ধর্ষণের ঘটনাটি ছিল বেশ আলোচিত। আমার সোর্স ছিল চমেকের জরুরি বিভাগে। ঈদের ছুটি শুরুর আগের রাতে পেজারে খবর এলো সীমার মরদেহ এসেছে। পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে নির্যাতনের শিকার মেয়েটি। আমি ছুটে গেলাম। কিন্তু পুলিশের নজরদারি ছিল বেশ। পরে একজন ডাক্তার ঢুকলেন। সীমার দেহের ওপরের সাদা চাদরটি সরালেন। আমি একটি ক্লিক করলাম। তখনো সীমার হাতে স্যালাইন লাগানো ছিল। পেছনে না তাকিয়ে সোজা বাইক নিয়ে এলাম অফিসে। সেই ছবি আজাদীতে ছাপা হলো। যদি আমি সেই ছবি না তুলতাম হয়তো সীমা হারিয়ে যেত। কারণ এরপর তিন দিন ঈদের ছুটিতে কাগজ বের হতো না।

আলোকচিত্র সাংবাদিক তাপস বড়ুয়া।   ছবি: সোহেল সরওয়ার, বাংলানিউজ

ছাত্রের পায়ে শেকল বেঁধে ওয়েল্ডিং

একটি মাদ্রাসার ছাত্রদের পায়ে শেকল বেঁধে ওয়েল্ডিং করে দিত। পায়ে ঘা হয়ে যেত। অনেক সময় দিয়ে অনেক ছবি তুলেছিলাম। এর সঙ্গে মোয়াজ্জেম ভাই আর ইমরানও ছিল। রয়টার্সের নিজাম ভাইকে একটি ছবি দিয়েছিলাম। সেটি বিশ্বজুড়ে আলোচিত ছবি হয়ে যায়। অনেক জায়গায় ছাপা হয়েছিল। এর মধ্যে বিশ্বখ্যাত লাইফ ম্যাগাজিনের দুই পৃষ্ঠাজুড়ে ‘বিগ পিকচার’ নামে আমার সেই ছবি ছাপানো হয়েছিল। আমার নামে, চিটাগাং লেখা ছিল ওই ছবিতে। সেদিন পাভেল রহমান বলছিলেন, বাংলাদেশের আর কারও বিগ পিকচার ছাপানো হয়নি লাইফ ম্যাগাজিনে।  

সিঁড়িঘর থেকে ম্যানেজারের রুমে

নব্বইয়ের দশকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গারা আসছিল। কুতুপালং গেলাম মোটরসাইকেল নিয়ে। তখন বর্ডারে রুটিন বাহিনী নামে বার্মিজ আর্মি ছিল। আমাদের সেনাবাহিনীও ছিল সতর্কাবস্থায়। ছবি তুলে বাসের চালকের হাতে দিয়ে ফ্লিম পাঠিয়ে দিলাম। রাতে কক্সবাজারে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন হোটেল কম ছিল। একটি হোটেলে গেলাম। তারা জানাল রুম নেই জানালেন। বললাম থাকতে হবে। তখন তারা বললেন, সিঁড়ি ঘরে থাকতে পারেন। নাম এন্ট্রি করছিলাম। যখন লিখলাম তাপস বড়ুয়া, দৈনিক আজাদী। তখন ম্যানেজার খুব অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, আপনার ছবি প্রতিদিন দেখি। কোনো দিন দেখিনি। আপনি আমার রুমে থাকবেন। খুব ভালো লেগেছিল তখন।

শিবিরের ক্যাডাররা অ্যাটাক করেছিল

তখন পুলিশ অস্ত্র দিয়ে আসামির ছবি তুলত। কিন্তু আসামির স্বজন ও সাঙ্গপাঙ্গরা জানত পুলিশ অস্ত্র পায়নি। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ছিল। তারা মনে করত, আমি বানানো ছবি দিয়েছি। কারণ ভালো-মন্দ সব ছবি মানুষ মনে করত আমার। একদিন দেওয়ানবাজার গেলাম বন্ধুর বাসায়। আমার মোটরসাইকেল সবাই চিনত। নিচে নেমে দেখি শিবিরের কিছু ক্যাডার মোটরসাইকেল ঘিরে ধরেছে। তারা বন্ধুকে বলল, আপনি চলে যান। একটি ট্যাক্সি দাঁড় করানো ছিল। আর্মস ছিল। এ সময় একজন পরিচিত লোক এলো। তিনি বললেন, কেমন আছেন। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ালেন। তখন শিবিরের ক্যাডাররা মোটরসাইকেলের হ্যান্ডেল ছেড়ে দিল। আমি এক টানে প্রেসক্লাব চলে এলাম। আমার শরীর কাঁপছিল।

জামায়াতের অনুষ্ঠান থেকে বেঁচে ফেরা

একদিন জামায়াতের একটি অনুষ্ঠানে গেলেন আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। আমিও গেলাম ছবি তুলতে। মুসলিম ইনস্টিটিউট কানায় কানায় ভর্তি। বক্তৃতা শুরু করলেন সম্পাদক। তিনি যুক্তি দিয়ে বললেন, আপনারা ব্যাংক করছেন, সুদ তো হারাম। বললেন, জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কথা। হলের দর্শক-শ্রোতারা ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। তখন জামায়াত নেতারা উনাকে আর আমাকে ঘিরে ফেললেন। আমরা কোনোমতে বেঁচে ফিরলাম।  

বাঘের ছানা পোষ মানে না

চিড়িয়াখানায় আমি ঘন ঘন যেতাম। বাঘের দুটি বাচ্চা হলো। ফিচার স্টোরি করি, কাভারেজ পাই। ওই বাঘের বাচ্চা দেথাশোনা করতেন মফিজ নামের এক কেয়ারটেকার। বাচ্চাগুলো একটু বড় হলো। একদিন অনুরোধ করলেন, উনি বাঘের খাঁচায় ঢুকে খাবার দেবেন, আমি যেন সেই ছবি তুলি। আমি রেডি খাঁচার বাইরে। উনি ভেতরে গেলেন খাবার নিয়ে। আত্মবিশ্বাস ছিল বাঘ কিছু করবে না তাকে। কিন্তু একটি বাঘের বাচ্চা তার কাঁধ বরাবর থাবা বসাল। শার্ট ছিঁড়ে গেল। নখ বসে গেল। উনি ভয়ে আর্তচিৎকার দিলেন। আমি সেই ছবি তুললাম। যা অনেক মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। ভাগ্য আমার সহায় ছিল।

মানুষের ছবি তোলাই পছন্দের

বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছবি তোলার প্রচুর সাবজেক্ট। আমি পছন্দ করি মানুষের ছবি তুলতে। বিদেশে মানুষের ছবি তোলার ঝামেলা অনেক। বোস্টনে আমি ঋতু পরিবর্তনের ছবি তোলার চেষ্টা করেছি। সেখান থেকে ৭৫টি ছবি নিয়ে চট্টগ্রামে একটি প্রদর্শনী করছি। শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হবে। বিকেলে চারটায় দৈনিক আজাদী সম্পাদক এমএ মালেক তিনি দিনের এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন।  

তরুণ আলোকচিত্রীর যা বললেন

যখন আমরা আলোকচিত্র সাংবাদিকতা করেছি তখন অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় অনেক সুবিধা পাচ্ছে। অনেকেই বেশ ভালো করছেন। আমি মনে করি, কাজের প্রতি একাগ্রতা থাকতে হবে। ছবি মানুষের মনকে অনেক টাচ করে। ইমোশনাল করে দেয়। দৃষ্টি থাকলে হাঁটতে হাঁটতে অনেক ভালো ছবি হয়ে যায়। কোনো মানুষের যদি সেন্স না থাকে তাকে যদি ফটোগ্রাফির সাবজেক্টের সাগরে ফেলে দিলেও হবে না। ফটোগ্রাফিকে মন থেকে নিতে হবে। কখনো ছোট ভাবলে হবে না। এনজয় করতে হবে। সময়, শ্রম ও একাগ্রতা থাকলে সফলতা আসবেই। এখন ছবি প্রচুর এডিট হচ্ছে কারচুপি হচ্ছে। নেচারাল রাখার, স্বকীয়তা রাখার মানসিকতা থাকতে হবে।

কাগজ টিকবে না, অনলাইনেই আপডেট

সত্যিকথা হচ্ছে, উন্নত বিশ্বে নিউজপেপারের পাঠক ও গ্রাহক কমে যাচ্ছে। এখন মানুষ নিউজপেপার কিনছে কম। বোস্টনের লিডিং নিউজপেপার ‘বোস্টন গ্লোব’ ও ‘ডেইলি হেরাল্ড’। আমি যখন প্রথম ২০০৩ সালে গিয়েছিলাম রমরমা ছিল। সব স্টোরে নিউজপেপার ছিল। এখন আর সেভাবে নেই। মানুষ কিনে না। সবার মোবাইল ও অনলাইনে নিউজ পাচ্ছে। আপডেট পাচ্ছে।         

বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৮
এআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad