ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

আদনানকে হত্যার পর ছাত্রলীগ নেতার বাসায় আশ্রয় নেয় খুনিরা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৮
আদনানকে হত্যার পর ছাত্রলীগ নেতার বাসায় আশ্রয় নেয় খুনিরা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: স্কুলছাত্র আদনান ইসফার (১৫) খুনে জড়িত যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা নগরীর চকবাজার-গণি বেকারি এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত।  চট্টগ্রাম কলেজ-মহসিন কলেজে আধিপত্য বিস্তারের জন্য কিশোর বয়সী এসব কর্মীদের ব্যবহার করেন চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রউফ।  হত্যাকাণ্ডের সময় খুনিরা যে পিস্তল ব্যবহার করেছিলেন সেটি তাদের দিয়েছিলেন এলাকার এক রাজনৈতিক বড় ভাই। 

হত্যাকাণ্ডের পর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত চারজন ফটিকছড়ি উপজেলার সমিতিরহাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মো.ফয়সালের বাড়িতে। ওই বাড়ি থেকেই পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে।

  অপর একজনকে নগরীর বাদুরতলা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

মহসিন কলেজের মাঠে খেলা, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ এবং হিরোইজম প্রদর্শন করতে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটার কথা জানিয়েছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-দক্ষিণ) শাহ মো.আব্দুর রউফ।

গ্রেফতার হওয়া পাঁচজন হলেন, নগরীর চান্দগাঁওয়ের হাজেরা তজু কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র মঈন খাঁন, সাব্বির খান ও মুনতাছির মোস্তফা, চকবাজার ডিসি রোডের হলি ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী এখলাছ উদ্দীন আরমান এবং ইসলামিয়া ডিগ্রী কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি পাস করা আবদুল্লাহ আল সাঈদ।  তাদের সবার বয়স ১৮ বছর বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এদের মধ্যে শুধুমাত্র মুনতাছির মোস্তফাকে নগরীর বাদুরতলা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অভিযান টিমে থাকা কোতয়ালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইমদাদ হোসেন চৌধুরী।

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ এবং গ্রেফতার পাঁচজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এডিসি রউফ বাংলানিউজকে জানান, সপ্তাহখানেক আগে মহসিন কলেজের মাঠে খেলা নিয়ে খুন হওয়া আদনান ও তার বন্ধুদের সঙ্গে জামালখানের আইডিয়াল স্কুলের দুই ছাত্রের কথা কাটাকাটি হয়।  

ঘটনার দিন ১৬ জানুয়ারি দুপুর ১টার দিকে আইডিয়াল স্কুলের দুই ছাত্রকে জামালখান মোড়ে দেখে ধাওয়া দেন আদনান ও তার কয়েকজন বন্ধু। ধাওয়া দিয়ে জামালখানে ‘মেজ্জান হাইলে আয়্যূন’ হোটেলের সামনে পর্যন্ত নিয়ে যায়। আইডিয়াল স্কুলের ওই দুই ছাত্রও রউফ গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মী।

মঈন, সাব্বির, সাঈদ, আরমান ও মুনতাছির এবং আরও তিনজন রাজনৈতিক বড় ভাই তখন কাজেম আলী মাষ্টার স্কুলসংলগ্ন মার্কেটে একটি দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ধাওয়া খেয়ে আইডিয়াল স্কুলের দুই ছাত্র তখন দৌড়ে গণি বেকারি পার হয়ে ওই দোকানে ঢুকে পড়ে।   সেখানে আড্ডারত বড় ভাইদের সাহায্য চান তারা।

তখন মঈন, সাব্বির, সাঈদ, আরমান ও মুনতাছির ওই দোকান থেকে বেরিয়ে ‘মেজ্জান হাইলে আয়্যূন’ হোটেলের সামনে এসে আদনানদের পাল্টা ধাওয়া দেন।   আদনানকে ফেলে তার বন্ধুরা পালিয়ে যায়।   সাব্বির এসে আদনানের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে মেরে ফেলার ‍হুমকি দেন এবং কিল-ঘুষি মারতে থাকেন।   আরমান ও সাঈদ লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকেন।

আদনান দৌড়ে পালানোর সময় জামালখানে খাজা আজমির ওয়ার্কশপের সামনে একটি সিএনজি অটোরিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে রাস্তায় পড়ে যান।   উঠে আবারও দৌড়ে পালানোর সময় মুনতাছির পেছন থেকে টি-শার্ট টেনে ধরলে পেছনের অংশ ছিঁড়ে রাস্তায় পড়ে থাকে।   তখন মঈন সামনে থেকে এসে আদনানের পেটের একপাশে ছুরিকাঘাত করে।   এরপর চারজন পেছনদিকে গণি বেকারির দিকে চলে যায়।  

আদনান জামালখান মোড়ে খাস্তগীর স্কুলের দিকে দৌঁড়ে যাবার সময় বারবার পেছন ফিরে রক্ত দেখছিল।   কিন্তু একপর্যায়ে সে লুটিয়ে পড়ে।   তবে মঈন তার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে খাস্তগীর স্কুলের কাছাকাছি পর্যন্ত যান।  পরে আবার পেছন ফিরে গণি বেকারির দিকে চলে যান।

এডিসি রউফ বাংলানিউজকে বলেন, বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঘটনায় জড়িতরা আদনানের মৃত্যুর খবর পান। এরপর তারা বাদুরতলা এলাকায় চলে যান।  রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা ফটিকছড়ির সমিতিরহাটে জনৈক ফয়সালের বাড়িতে পৌঁছান।

ফয়সাল সমিতিরহাট ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি বলে বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছে পুলিশের একাধিক সূত্র।

সূত্রমতে, নগরীর চন্দনপুরা পশ্চিম গলির বাসিন্দা আব্দুর রউফ গত এক বছরে চট্টগ্রাম কলেজ-মহসিন কলেজকেন্দ্রিক ছাত্রলীগ নামধারী একটি বলয় গড়ে তুলেছে। মহসিন কলেজের ছোট গেইটের পাশে আগে শিবিরের যেসব মেস ছিল, সেগুলো পুলিশ একসময় তল্লাশি ‍চালিয়ে খালি করে।   একটি মেসের দুটি কক্ষ দখলে নিয়ে রউফ কয়েকজন কর্মীকে সেখানে রাখেন।   আর রউফের গ্রুপের কর্মীরা সবসময় আড্ডা দেন ‘মেজ্জান হাইলে আয়্যূন’ হোটেলে। কাজেম আলী স্কুলসংলগ্ন জনৈক মামুর দোকানেও তারা আড্ডা দেন।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার আব্দুর রউফের মোবাইলে চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, হত্যাকাণ্ডে রউফের সম্পৃক্ততা আমরা এখনও পাইনি।   তবে সম্পৃক্ততার তথ্য পেলে তাকেও গ্রেফতার করা হবে।  বড় ভাই, ছোট ভাই যাদের বিষয়ে তথ্য পাব, তাদের গ্রেফতার করব।

কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.জসিম উদ্দিন বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, খুনের ঘটনায় আদনানের বাবা আকতারুল আজম বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন।   এতে গ্রেফতার হওয়া ৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।   অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গত ১৬ জানুয়ারি নির্মম খুনের শিকার আদনান ছিলেন কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র।   তার বাবা এলজিইডিতে কর্মরত প্রকৌশলী।   নগরীর জামালখানে প্রেসক্লাব ভবনের পেছনে তাদের বাসা।

বাংলাদেশ সময়:  ১৬৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৮

আরডিজি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।