পঞ্চশের দশকে গ্রামের পশ্চাৎপদ চিন্তাধারাকে পেছনে ফেলে তিন বোন পড়তে এসেছিলেন খাস্তগীর স্কুলে। বর্তমানে সত্তর পেরুনো তিন বোন হলেন সখিনা ইউসুফ, রিজিয়া বেগম ও সানোয়ারা বেগম।
নব্বইয়ের দশকের ছাত্রী শিক্ষিকা গৌরি নন্দিতা কিংবা সদ্য মাধ্যমিক শেষ করে স্কুল ছেড়েছেন তিন বান্ধবী কানিজ ফেরদৌস, রওনক জাহান ও ফাইরুজ সরওয়ার।
এভাবেই শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মেলবন্ধন ঘটেছে ডা.খাস্তগীর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১১১ বছর পূর্তিতে। কুয়াশাঘেরা ভোরে সবুজ আঙ্গিনায় দুর্বাঘাসের উপর জমা শিশিরবিন্দু যেমন এক হয়ে উপচে পড়ে জলের ধারায়। তেমনি করে হাসি-আনন্দের ঝর্ণাধারায় পুর্নমিলনিতে এক হয়েছিলেন খাস্তগীরের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। হাসি-ঠাট্টা, পুরনো দিনের স্মৃতি ছুঁয়ে দেখা, গল্প-আড্ডায় দিনটি পার করছেন তারা।
অনন্য খাস্তগীর ১১১-তম বর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি বলেন, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আমি মনে করি পৃথিবীর এমন একটি প্রান্ত যেখানে সবাই আসে তাদের জীবনটাকে মনোরমভাবে সাজাতে। আমি মনে করি এই স্কুলটি সবসময় তার শিক্ষার্থীদের মনোরম জীবন সাজাতে অনুপ্রাণিত করে। এই স্কুলের ছাত্রী ছিল প্রীতিলতা ওয়াদ্দার, যিনি স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এই স্কুলের শত, শত ছাত্রী চাই যারা সমাজকে, সারা বিশ্বকে আলোকিত করবেন।
জাতীয় সঙ্গীতকে শুদ্ধ এবং পূর্ণাঙ্গভাবে গাওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আমাদের সংবিধানে জাতীয় সঙ্গীতের ১০ লাইন লেখা আছে। আমি চাই, এই স্কুলসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেন জাতীয় সঙ্গীত শুদ্ধভাবে এবং ১০ লাইনই গাওয়া হয়। এই স্কুল শুধু সুশিক্ষা প্রদানে নয়, সংস্কৃতিমনস্ক মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা যেন দেয়।
খাস্তগীর স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ডা.অন্নদাচরণ খাস্তগীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান এই কথাসাহিত্যিক।
পুর্নমিলনীতে এসে সখিনা ইউসুফ সেদিনের ছাত্রীনিবাসের জন্য স্মৃতিকাতর হন, যিনি ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক শেষ করেছিলেন। স্কুলের মূল ভবন দেখিয়ে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখানে হোস্টেল ছিল। আমরা এখানে থাকতাম। ফটিকছড়িতে গ্রামে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পর আর সুযোগ ছিল না। তখন গ্রামের মুসলিম সমাজে মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করাটা ভালো চোখে দেখা হত না। আমার বাবা বার্মায় ব্যবসা করতেন। আমার মা তিন বোনকে পাঠিয়ে দিলেন খাস্তগীর স্কুলে হোস্টেলে। এই স্কুল আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে।
সখিনার ছোট বোন রিজিয়ার আক্ষেপ আছে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়লেও খাস্তগীর থেকে মাধ্যমিক পাশ করতে পারেননি। তার আগেই বিয়ে হয়ে যায় এবং পড়ালেখায় ইতি টানতে হয় বলে তিনি জানালেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দুইতলা বিল্ডিং, নিচে ক্লাস হত, উপরে হোস্টেল। এই মাঠে আমরা কত খেলেছি ! বাথরুমটা ছিল জঙ্গলের ভেতর। যেতে ভয় লাগত। তখন সবাই মিলে বাথরুমে যাওয়া ছিল আমাদের জন্য এটা মজার কাণ্ড।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড.শিরীন আক্তারও এই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। তিনিও এসেছিলেন পুর্নমিলনীতে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ১৯৬৪ সালে আমি ক্লাস ফোরে ভর্তি হই। হোস্টেলে থাকতাম। খুব ভূতের ভয় করত। সবাই বলত, খাস্তগীর স্কুল তো আগে হাসপাতাল ছিল। মরা মানুষের হাড্ডি সব গাছের নিচে আছে। সেজন্য ভূতের ভয়। বাথরুমে একা যেতে পারতাম না। সবসময় চোখ বন্ধ করে থাকতাম। মাঝরাতে কান্না করে দিতাম। খবরটা অভিভাবকদের কাছে পৌঁছল। তারা এসে টিচারদের বললেন। টিচাররা বলল, স্কুলে ভূত নেই। ওদের মনের ভূত আগে তাড়াতে হবে।
২০১৭ সালে এসএসসি পাস করা রওনক জাহান বললেন, ‘খাস্তগীর স্কুল হচ্ছে আমাদের আইডেনটিটি। আমাদের অস্তিত্ব। যখন কেউ শুনে আমরা খাস্তগীরের ছাত্রী ছিলাম, তখন অনেক সম্মান করে। এটাই আমাদের অনেক ভালো লাগে। ’
১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক পাস করা রোকেয়া খানম বাংলানিউজকে বলেন, আমার খালা জোবেদা খাতুন এই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। আমি এই স্কুলে পড়েছি। আমার পাঁচ মেয়ে এই স্কুলে পড়েছে। আমার এক নাতনি এই স্কুলে পড়ছে। আমরা সবাই খাস্তগীর স্কুলের ছাত্রী, এটা আমাদের গর্ব।
২০১৭ সালে এসএসসি পাস করা সেঁজুতি সোমের ইচ্ছা ছিল, তার মায়ের স্কুলেই পড়বেন। তার মা নগরীর অপর্ণাচরণ সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা গৌরি নন্দিতা ১৯৯১ সালে খাস্তগীর স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। মেয়েকে নিজে যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেখানে ভর্তি করাতে চেয়ে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত খাস্তগীর স্কুলে কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকে যান সেঁজুতি সোম।
মায়ের স্কুলে পড়ার জেদ নিয়ে এখন অনেক গর্ব গৌরি নন্দিতার। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা মা-মেয়ে খাস্তগীরের ছাত্রী। অনেক গর্বের, অনেক আনন্দের।
মেলবন্ধনের চিত্রটিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে আয়োজক কমিটির সভাপতি ডা.শাহানারা চৌধুরী বক্তব্যে বলেন, এই যে একজন আরেকজনকে দেখে বলছেন ‘ও আল্লাহ, তুমি না’, ‘তুমি কোন ব্যাচের’, ‘আরে চিনি চিনি লাগছে’ এটাই আমরা চেয়েছিলাম। ইচ্ছে করে প্রতিবছর যেন এভাবেই মিলিত হতে আমার ইচ্ছা করছে।
১১১ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন আয়োজন শনিবার পর্যন্ত চলবে বলে আয়োজকরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৮
আরডিজি/টিসি