ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

দখলযুদ্ধে জিততে সন্তান বলি!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৭
দখলযুদ্ধে জিততে সন্তান বলি! জবাইয়ের পর ৫ মাস বয়সী শিশুকে হাতে ঝুলিয়ে দখল স্থলে দাদী। ছবি: পিবিআই

ঢাকা: মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের দুই প্রতিবেশী নিজাম মিয়া এবং মধু মিয়ার মধ্যে জমি নিয়ে ‍তুমুল বিরোধ। একদিন মধু মিয়া দলবল নিয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিজামের জমি দখল করতে আসেন।

শুরু হয় দু’পক্ষে লড়াই।  এর মাঝে হঠাৎ সেখানে দেখা যায় নিজামের পাঁচ মাস বয়সী মেয়ে ইভা বেগমের রক্তাক্ত নিথর দেহ নিয়ে সেই জমিতে তার পরিবারের সদস্যরা আহাজারি করছেন।



সাধারণ দৃষ্টিতে এই বর্ণনায় মনে হবে, মধু মিয়ার দলের হাতে খুন হয়েছে ইভা।   কিন্তু পাঁচ বছর আগের চাঞ্চল্যকর এই খুনের নেপথ্যে ভিন্ন কাহিনী জানাচ্ছে মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।


পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার তদন্তের ফলাফল বাংলানিউজের কাছে বর্ণনা করেছেন এভাবে, দখল ঠেকাতে এবং প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এক ধরনের গ্রাম্য রাজনীতির আশ্রয় নেয় নিজাম মিয়ার পরিবার।   নিজামের মা বীরু বেগম তার দুই ছেলে আবুল মিয়া ও রাশিদ আলীকে নির্দেশ দেন নিজামের মেয়ে ইভাকে হত্যা করার জন্য।

‘আবুল মিয়া মায়ের নির্দেশ মেনে ইভাকে জবাই করেন।   তারপর সেই রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ইভার মা রুবিনা বেগম যান ঘটনাস্থলে।   এই কৌশলে কাজ হয়।   হঠাৎ খুন দেখে ভড়কে যান দখলদাররা।   তারা দখল করতে আসার সময় আনা ট্রাক্টর ফেলে পালিয়ে যান।   সন্তানকে বলি দিয়ে দখলযুদ্ধে জয়ী হয় নিজাম মিয়ার পরিবার। ’ বলেন বনজ কুমার মজুমদার।

পিবিআই লোগো।  ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে এই ঘটনার পর নিজাম মিয়া বাদী হয়ে কুলাউড়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।   মামলায় মধু মিয়া ও তার ভাই মাসুদ মিয়াসহ অজ্ঞাতনামা লোকজনকে আসামি করা হয়।

সূত্রমতে, ওই মামলা তদন্তে গিয়ে কুলাউড়া থানা পুলিশ খুনের অভিযোগ প্রমাণ করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন।   বাদী নারাজি দিলে আদালত সরাসরি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেন।   সাক্ষ্যপ্রমাণ না পেয়ে আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আবারও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।   বাদী আবারো নারাজি দেন।   আদালত মৌলভীবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেন।   ফলাফল আসে আগের মতোই।

আদালতের নির্দেশে ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মামলাটি’র তদন্তভার নেয় পিবিআই।   তদন্তের দায়িত্ব পান জেলা পিবিআই’র পরিদর্শক মো.তরিকুল ইসলাম।   ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার মামলার এজাহার এবং আগের চূড়ান্ত প্রতিবেদনগুলো নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করেন।   এরপর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে।

পরিদর্শক তরিকুল বাংলানিউজকে বলেন, দখলদাররা শক্তিশালী হয়েও কেন পাঁচ মাসের শিশুটিকে হত্যা করল? এজাহারে বলা হয়েছে, মা রুবিনা বেগমের কোলে থাকা অবস্থায় ইভার গলায় কোপ দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে।   প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে মায়ের ঘাড়ে আঘাত লাগেনি কেন? মায়ের সালোয়ার কামিজে রক্ত লেগে থাকার কথা ছিল। কিন্তু আলামতে সেটি নেই কেন?

‘তিনটি পয়েন্টে তদন্তে নেমেই সূত্র পেয়ে যাই।   এরপর চলতি বছরের ১১ জুলাই নিজামের ভাই আবুল মিয়া এবং ১৮ অক্টোবর রাশিদ আলীকে গ্রেফতার করি।   দুজনই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ’

তরিকুল জানান, জবানবন্দিতে দুজনই জানিয়েছেন, মায়ের নির্দেশে আবুল মিয়া বটি দিয়ে শিশু ইভার ঘাড়ে আঘাত করে তাকে হত্যা করেন।   এরপর পরিকল্পনামত ইভার মা রুবিনা রক্তাক্ত সেই দেহ নিয়ে জমিতে গিয়ে আহাজারির নাটক সাজান।  

এদিকে আবুল মিয়াকে গ্রেফতারের পরই নিজাম ও তার স্ত্রী রুবিনা গা ঢাকা দিয়েছেন এবং নিজামের বৃদ্ধা মা বীরু বেগম সম্প্রতি মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন পিবিআই পরিদর্শক তরিকুল।

পাঁচ মাসের মেয়েটিকে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের মা-বাবা, দাদী, চাচা মিলে খুন করাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে’ বর্ণনা করে অভিযোগপত্র তৈরি করছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

তবে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের বিশ্লেষণ ভিন্ন। চৌকস এই কর্মকর্তার মতে, ইভা যদি মেয়ে না হতো, তাহলে তাকে পরিবারের সম্পদ রক্ষায় বলি দেওয়া হতো না কখনোই।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৭
আরডিজি/টিসি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।