ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রিতদেরও জীবন বাঁচাচ্ছে বাংলাদেশ

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭
নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রিতদেরও জীবন বাঁচাচ্ছে বাংলাদেশ নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। ছবি: সোহেল সরওয়ার-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

তুমব্রু (বান্দরবান) থেকে: পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু। মিয়ানমার আর বাংলাদেশকে ভাগ করেছে তুমব্রুর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি খাল। খাল মানে হেঁটেই পার হওয়া যায় এমন একটি জলাশয়। খালের একপারে তুমব্রু, অন্যপারে নো-ম্যানস ল্যান্ড, এরপর মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে এসে এই নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা। একইভাবে নাইক্ষ্যংছড়ির কোণাপাড়া এবং ঘুমধুম এলাকায় নো-ম্যানস ল্যান্ডে আটকে আছে আরও প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা।

এসব রোহিঙ্গা এখনও বাংলাদেশে প্রবেশ করেননি কিংবা অনুপ্রবেশের সুযোগ পাননি। তবে তাদের তিনবেলা খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি।

শুধু খাবার নয়, খালের এপার থেকে নো-ম্যানস ল্যান্ডে সরবরাহ করা হয়েছে গৃহনির্মাণ সামগ্রী, এমনকি পাঠানো হচ্ছে ওষুধও।

তুমব্রু এবং ঘুমধুম সীমান্ত নিয়ন্ত্রণকারী ৩৪ ব্যাটেলিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে.কর্নেল মঞ্জুরুল আহসান খান বাংলানিউজকে বলেন, যারা নো-ম্যানস ল্যান্ডে আছেন তাদের আমরা সহযোগিতা না করেও পারতাম। কিন্তু এটা মানবতার বিষয়। এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক ও মানবিক কর্তব্য। সেই বিবেচনায় আমরা তাদের তিনবেলা রান্না করা খাবার দিচ্ছি। অন্যান্য সহযোগিতাও করছি। এই খালের একপারে তুমব্রু, অন্যপারে নো-ম্যানস ল্যান্ড, এখানেই আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গারা

বিজিবি নিজস্ব উদ্যোগে এবং ত্রাণ সংগ্রহের মাধ্যমে প্রতিদিন নো-ম্যানস ল্যান্ডে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দিচ্ছে বলে জানান তিনি।

তুমব্রু এলাকায় গিয়ে কথা হয় নো-ম্যানস ল্যান্ডে বসবাসকারী ২৫ বছরের রোহিঙ্গা নারী হুমায়রার সঙ্গে। স্বামী হারিয়ে তিন সন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন তিনি। মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া পার হলেও বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় আছেন।

হুমায়রা বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কোন সমস্যা হচ্ছে না। বিজিবি আমাদের তিনবেলা খাবার দিচ্ছে। খিচুড়ি দিচ্ছে, ভাত দিচ্ছে।

নো-ম্যানস ল্যান্ডে বসবাসরত ৬৫ বছরের বৃদ্ধা সোনা মেহের খাল পাড় হয়ে তুমব্রু এলাকায় আসেন ওষুধের জন্য। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি অসুস্থ মানুষ। গা বিষ (ব্যাথা) করছে। এজন্য দাবাই (ওষুধ) নিতে এসেছি। বিজিবি আমাদের দাবাই দিয়েছে। নো-ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা

৬০ বছরের বৃদ্ধ শফি আলম বাংলানিউজকে বলেন, খাওয়ার সমস্যা নাই। শুধু বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে একটা ভালো থাকার জায়গা যদি পেতাম, ভাল হতো।

নো-ম্যানস ল্যান্ডে বসবাসকারীরা জানান, ২৪ আগস্ট রাতে প্রথম দফাতেই মিয়ানমারের ঢেকিবুনিয়াসহ আশপাশের গ্রামে হামলা করে সেনাবাহিনী। নির্বিচারে গুলির পাশাপাশি তাদের বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রাণভয়ে রাতেই পালিয়ে আসেন তারা। তবে খালের পাড়ে আসার পর তাদের প্রথমে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অনেকে ঢুকতে পারলেও যাদের পরিবারের সদস্য বেশি তারা ঢুকতে পারেননি।

এরপর বিজিবির পক্ষ থেকে নো-ম্যানস ল্যান্ডেই তাদের থাকার জন্য বলা হচ্ছে।

নো-ম্যানস ল্যান্ডে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে বিজিবি কর্মকর্তা লে.কর্নেল মঞ্জুরুল আহসান খান বাংলানিউজকে বলেন, তাদের ঢুকতে দিচ্ছি না, এই অভিযোগ সত্য নয়। বালুখালীতে জায়গা নির্ধারিত হলেই তাদের ঢুকতে দেওয়া হবে। আর ঢুকতে না দিলেও তাদের মানবিক সহায়তা দিতে আমরা কোন ধরনের কার্পণ্য তো করছি না। আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা

এদিকে রোববার দুপুরে নো-ম্যানস ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাদের দেখতে যান বাংলাদেশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও। তিনি বলেন, বিজিবি মানবিক সেবা নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করছে। বিজিবি যে রোহিঙ্গাদের খাবার দিচ্ছে, ওষুধ দিচ্ছে তা নিজের চোখে দেখেছি। তাদের এই কার্যক্রম প্রশংসার যোগ্য। বিজিবি তো বাংলাদেশেরই প্রতিনিধি। তারা যে মানবিকতা নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, সহযোগিতা করছে এজন্য তাদের সাধুবাদ জানাই।

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনাচৌকিতে একযোগে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগরা নির্বিচারে হত্যার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। প্রাণের ভয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসতে শুরু করেন বাংলাদেশে।

বান্দরবান এবং কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত পার হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার হিসাবমতে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। তবে স্থানীয়দের মতে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পরিমাণ ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৭

আরডিজি/আইএসএ/টিসি

আরও পড়ুন

**বাবা-মা হারা রোহিঙ্গা শিশুদের তালিকাভুক্ত করছে সরকার

**রোহিঙ্গাদের রুখতে কাঁটাতারের বেড়া মজবুত করছে মিয়ানমার

**অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে খ্রিষ্টান ধর্মগুরু

**শৃঙ্খলা এনেছে সেনাবাহিনী

**‘রোহিঙ্গারা এখন ইতিহাসের ক্রসফায়ারে’

**ভোরের আলো ফুটতেই মাঠে সেনাসদস্যরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।