ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘রোহিঙ্গারা এখন ইতিহাসের ক্রসফায়ারে’

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৭
‘রোহিঙ্গারা এখন ইতিহাসের ক্রসফায়ারে’ রোহিঙ্গারা এখন ইতিহাসের ক্রসফায়ারে বলে মন্তব্য করেছেন ড. শামসুল হোসাইন

কক্সবাজার থেকে: মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নাগরিকরা এখন ‘ইতিহাসের ক্রসফায়ারে’ আছেন এমন মন্তব্য এসেছে ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ড. শামসুল হোসাইনের কাছ থেকে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাসের আলোকে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এবং আরাকান রাজ্য নিয়ে গবেষণা করছেন। রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ বলা নিয়েও ঘোর আপত্তি এসেছে এই ইতিহাসবিদের কাছ থেকে।

শামসুল হোসাইন বলেছেন, রোহিঙ্গারা এখন ইতিহাসের ক্রসফায়ারে আছেন। বার্মা (মিয়ানমার) তাদের রাষ্ট্রহীন করেছে।

উদ্বাস্তু হয়ে যে দেশে তারা আশ্রয় নিয়েছে সেই বাংলাদেশও তাদের নিয়ে আতঙ্কে আছে। বার্মা তাদের প্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে মাইন বসিয়েছে।
তাহলে এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর দেশ কোনটা? তারা কি ইতিহাসের ক্রসফায়ারে নেই? তা্রা তো এখন ইতিহাসের মাইনফিল্ডের ওপর দিয়ে হাঁটছে।

মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করতে কক্সবাজারে অবস্থান করা শামসুল হোসাইন আরও বলেন, একটা বিশাল জনগোষ্ঠেীকে মিয়ানমার নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। তাদের সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের প্রবেশ ঠেকাতে মিয়ানমার সীমান্তে মাইন বসিয়েছে। রাষ্ট্রহীন অবস্থায় বিশাল একটা জনগোষ্ঠী। ‘মিয়ানমার তাদের গ্রহণ করছে না। বাংলাদেশ তাদের গ্রহণ করবে এমন কোনো যৌক্তিক কারণও নেই। সুতরাং তারা যে ইতিহাসের ক্রসফায়ারে আছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ’

রোহিঙ্গাদের বাঙালি সন্ত্রাসী উল্লেখ করে অং সান সুচির দেয়া বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের বাঙালি বলা হবে কেন? তাদের ভাষা একই বলে? তাদের ভাষা হচ্ছে রোহিঙ্গা ভাষা। আমরা যারা চট্টগ্রামের মানুষ, আমাদের ভাষা হচ্ছে চাটগাঁইয়া ভাষা। ভাষার মধ্যে মিল কিছুটা থাকতেই পারে। তারা হচ্ছে আরাকানি। আমরা হচ্ছি চাটগাঁইয়া, বাংলার অংশ। আরাকানিরা তো বাংলার অংশ নয়। তাহলে তাদের বাঙালি বলা হবে কেন? ‘মধ্য-পূর্ব যুগে চট্টগ্রামের নাম ছিল হরিকেল। সুলতানি আমলে আমাদের আরাকান রাজ্যের অধীনে নেওয়া হয়েছিল। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পৌনে ১০০ বছর আমরা আরাকানের অধীনে ছিলাম। মোঘল আমলে আরাকান সাম্রাজ্য যেটা ফেনী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেটা আলাদা হয়। ’

‘ব্রিটিশ আমলে আরাকান কিংবা বার্মা আলাদা কোনো রাষ্ট্র ছিল না। এটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বা ভারতীয় উপমহাদেশের অধীনে ছিল। পরে বার্মা আলাদা রাষ্ট্র হয়। প্রকৃত যে আরাকান সেটা তাদের অধীনে থাকে। আমরা যারা চট্টগ্রামবাসী যারা আগে হরিকেল রাজ্যের অধীনে ছিলাম, আমরা বাংলার অধীনে গেলাম এবং আছি। পৌনে ১০০ বছর বাদ দিলে আমরা বাংলার অধীনেই ছিলাম। ’

‘সুতরাং আমরা আরাকানি না। রোহিঙ্গারাও বাঙালি না। আর বাঙালি সন্ত্রাসী যেটা বলা হচ্ছে সেটাও সঠিক না। ’

তিনি বলেন, সন্ত্রাসী মানে কি? সন্ত্রাসী মানে দুষ্টু লোক। লাখ লাখ মানুষকে মিয়ানমার সন্ত্রাসী বলছে। লাখ লাখ মানুষ কি সন্ত্রাসী হতে পারে? ‘সন্ত্রাসী সবদেশে আছে। সন্ত্রাসী কোন দেশে নেই? ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় যুব বিদ্রোহের সঙ্গে যারা ছিল সেই সূর্য সেনদের ব্রিটিশরা সন্ত্রাসী বলত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদেরও পাকিস্তানিরা সন্ত্রাসী বলত। তাই বলে তারা কি সন্ত্রাসী ছিল?’

‘তাদের নাগরিকত্ব নেই, শিক্ষা নেই, রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই, তাহলে রোহিঙ্গাদের দোষ কি?’ বলেন শামসুল হোসাইন।

তবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর ড.শামসুল হোসাইন।

‘আমাদের ভৌগোলিক সীমা খুব সীমিত। এমনিতেই আমরা জনসংখ্যার চাপে আছি। এর ওপর ১০ লাখ রোহিঙ্গার চাপ। তারা উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসেছে। যদি এমন হতো যে তারা খুব ধনবান, তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু তারা তো সব হারিয়ে এ দেশে এসেছ। অন্তত তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং বেশভূষায় যা দেখেছি। ’

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সামাজিক সমস্যা তৈরি হবে। বাংলাদেশের ওপর নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হবে। কারণ বঞ্চিতরা প্রতিশোধ নিতে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারে। আর্থিক সংকটও তৈরি হবে। কারণ আমি দেখেছি ট্রাক-মাইক্রোবাস-টেম্পু করে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে ত্রাণ দিয়ে কি তাদের সংকট মোকাবেলা সম্ভব? প্রতিদিন ১০০ ট্রাক ত্রাণ দিয়েও তো সংকট মোকাবেলা সম্ভব না।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংকট মোকাবেলার দায় বিশ্বকে নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

‘এই সমস্যা বৈশ্বিক সমস্যা। এই দায় বিশ্বকে নিতে হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিয়ে একটা নির্মোহ গবেষণা হতে হবে। এর ভিত্তিতে মিয়ানমারকে আলোচনার টেবিলে আনতে হবে। তারপর সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। ’ বলেন এই ইতিহাসবিদ।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪,২০১৭
আরডিজি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।