বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা এভাবেই তুলে ধরছিলেন বাংলানিউজের দুই কর্মী স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রমেন দাশগুপ্ত ও সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট সোহেল সরওয়ার। সম্প্রতি উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ও সীমান্ত এলাকা ঘুরে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার প্রকৃত চিত্র তুলে এনেছেন তারা।
শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের চট্টগ্রাম ব্যুরো কার্যালয়ে অভিজ্ঞতার ডালি মেলে ধরেন তারা।
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রমেন দাশগুপ্ত বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে রোহিঙ্গারা ওপার থেকে এপারে আসছে।
এই যে শরণার্থীদের কষ্টগুলো, এগুলো যে কতটা অমানবিক, কতটা নৃশংস এবং তারা যে কতটা অসহায় তা ভাষায় প্রকাশ করাটা কঠিন। এ ধরনের কষ্টগুলো মানুষের মনকে স্পর্শ করে, হৃদয়কে নাড়া দেয়, ভারাক্রান্ত করে। ’
সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট সোহেল সরওয়ার বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখেছি বিভিন্ন ক্যাম্পে। কুতুপালং-নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তমব্রু-পালংখালী-নাফ নদী সহ প্রায় সব পয়েন্টেই গিয়েছি। এখনো রোহিঙ্গারা কমবেশি আসছে, যাদের বেশিরভাগই নারী-শিশু। নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে গিয়ে কাঁটাতারের ওপারে আগুনের জ্বলন্ত শিখা দেখেছি। ওই ছবি বাংলানিউজে দিয়েছি। কাঁটাতার পার হয়ে রোহিঙ্গারা আসছে-এই ছবিও দিয়েছি।
নো-ম্যান্স ল্যান্ডে রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার বসতি, যেখানে গুলিবিদ্ধ ৭ বছরের শিশু দেখেছি। ৩ বছরের শিশু যার বাবা-মা হত্যা করা হয়েছে এমনও দেখেছি। আবার ক্ষুধার জ্বালায় শিশুদের কান্না, দেখেছি ৭ দিন ধরে খেতে পারেনি এমন রোহিঙ্গাদেরও। উখিয়া দিয়ে আসার সময় দেখেছি শতবর্ষী বৃদ্ধা মাকে ঝুড়িতে করে নিয়ে আসছে ছেলে ও নাতি। তাদের প্রত্যেকের চোখে-মুখে বর্বর নির্যাতনের ছাপ দেখেছি। ’
ত্রাণ নিতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ত্রাণ নেওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছে নারী ও শিশুরা। গাড়ির পেছনে দৌড়ে দৌড়ে অনেকে ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারছে না। এছাড়া বেশিরভাগ নারীরই ৫-৬টা করে বাচ্চা। তাদের রেখে মা যদি ত্রাণের জন্য দৌড়ায় তাহলে বাচ্চারা অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে। ৫ লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে আসায় কে কোথায় আছে তারা নিজেরাই খুঁজে পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে যোগ করে রমেন দাশগুপ্ত বলেন, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ অনেকে দিচ্ছে। অনেকে ভোর থেকে গাড়ি-কাভার্ডভ্যান–ট্রাকে করে ত্রাণ দিচ্ছে। তবে এত মানুষ এসেছে লাখ লাখ মানুষের জন্য এভাবে ত্রাণ দেওয়ার সময় স্বেচ্ছাসেবকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এত মানুষের তুলনায় ত্রাণের পরিমাণও অপ্রতুল। চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে একটি ত্রাণের গাড়ি দেখলেই হাজার হাজার হাত এগিয়ে আসছে। তবে রোহিঙ্গাদের প্রতি সবার সহানুভূতি সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসার চিত্র দেখে মনে হয়েছে অসহায় রোহিঙ্গাদের পাশে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে পুরো বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে গেছে।
রোহিঙ্গাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন-‘আমি যদি ১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারি, ৮-১০ লাখ মানুষকেও খাওয়াতে পারবো। ’ তিনি বিভিন্ন সময় ভাষণে ৭৫’এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বিদেশে ৫-৬ বছর ছিলেন তুলে ধরে বলেছেন-‘আমিও ৫-৬ বছর শরণার্থী জীবনে ছিলাম, শরণার্থীদের কষ্ট আমি বুঝি। ’
প্রধানমন্ত্রী মানবিক দিক থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘেও সাধারণ অধিবেশন সহ প্রত্যেকটি সাক্ষাতে বিশ্ব নেতাদের কাছে রোহিঙ্গাদের কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন। এছাড়া ত্রাণ বিতরণকে আরও সুশৃঙ্খল ও রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে কাজ করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছেন।
এ বিষয়ে রমেন দাশগুপ্ত বলেন, রোহিঙ্গারা আসার পর প্রথম ৫-৭ দিন ত্রাণ বিতরণে খুবই বিশৃঙ্খলা ছিল। বিস্কুট-মুড়ির প্যাকেট গাড়ির ওপর থেকে ছুঁড়ে মারা হচ্ছিল। এগুলো নিতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে অনেক শিশু ব্যথা পেয়েছে, দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে। পরে শৃঙ্খলা আনার জন্য জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিল ব্যক্তিগত বা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে কোন ত্রাণ দেওয়া যাবে না। জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ভাণ্ডারে জমা দিতে বলা হলো, সেখান থেকে প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। সেই উদ্যোগ ফলপ্রসু হলেও ত্রাণ বিতরণে পুরোপুরি শৃঙ্খলা আনাটা কষ্টসাধ্য। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে আশা করি ত্রাণ বিতরণে পুরোপুরি শৃঙ্খলা আসবে ও ত্রাণের জন্য রোহিঙ্গাদের যে হাহাকার তা অনেকটা কমে আসবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭
আইএসএ/টিসি/জেডএম