শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) নিজের সেই বড় পরিচয় ভুলে বর্ষীয়ান রাজনীতিক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যেন মিশে গেলেন সাধারণের কাতারে। কোনো সস্তা দেখনদারি মনোভাব ছিল না তাতে, দেখালেন কেবল একটাই জিনিস-কাজে চূড়ান্ত আন্তরিকতা।
সকালে প্রাতভ্রমণ ও ইয়োগা অনুশীলন করা মানুষদের সংগঠন ‘ইয়োগা প্রভাতী’ ডিসি হিল প্রাঙ্গণ পরিষ্কারের এই উদ্যোগ নেয়। ‘পরিচ্ছন্নতা নিজেরাই করি, কারও জন্য অপেক্ষা নয়’-শীর্ষক এই উদ্যোগে সামিল হন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও।
গায়ে টি-শার্ট, পরনে সাদা ট্রাউজার আর কব্জি অবদি গ্লাভসে মুড়িয়ে মন্ত্রী যখন ঝাড়ু হাতে নিলেন সূর্য ত্বকপোড়া রোদ ছড়াতে শুরু করেছে কেবল। সেই গরমে পরিশ্রমসাধ্য কাজ করায় মন্ত্রীর কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছিল অনবরত। তাতে দমবার পাত্র নন তিনি। রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে আবারও কাজে মনোযোগ। তাকে ঘিরে থাকা থিক থিক ভিড় যখন কাজ করতে অসুবিধা বাধাচ্ছিল সেই ভিড়ের উদ্দেশে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মন্ত্রীর কড়া জবাব-‘তোয়ারা তোয়ারার হাজ গরো, আই আ্যার গিন গরি (তোমরা তোমাদের কাজ করো, আমি আমারটা করি)। ক্যামেরার ল্যান্স যখন বারবার তার দিকে তাক করা হচ্ছিল-মন্ত্রীর সরল জবাব-‘ছবি তোলার জন্য আসিনি’।
কাজের ফাঁকে একটা-দুটো ফোনও এসেছে। ব্যক্তিগত সহকারী মোবাইল ফোনটা ধরিয়ে দিতেই হাসিমুখে উত্তর-‘আমি এখন সুইপার হয়ে গেছি। সিটি করপোরেশনের হয়ে বিনাবেতনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছি। পরে কথা বলবো। ’
এর আগে মন্ত্রী কিভাবে কাজ শুরু করবেন তা দেখিয়ে দেন। ‘ইয়োগা প্রভাতী’র ৮১ জন সদস্য ছাড়াও এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশ নেন বেশ কিছু শ্রমিক। ডিসি হিলের দক্ষিণপ্রান্তে বসার জন্য তৈরি সিঁড়ি থেকে কাজ শুরু করেন মন্ত্রী ও অন্যরা। প্রায় এক ঘণ্টা শেষে উত্তরপ্রান্তের সিঁড়ি পর্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা শেষ করেন তারা।
ঢাকায় নিয়মিত প্রাতভ্রমণে বের হন রমনা পার্কে। প্রিয় চট্টগ্রামে আসলে ডিসি হিলই তার প্রিয় ঠিকানা। কর্মসূচির শুরুতে তাই বলে গেলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
মন্ত্রী বলেন, ‘২০০১ সালে আমি এখানে হাঁটার জন্য পার্ক করার উদ্যোগ নিই। সেসময় বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ আসছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আমাকে ফোন করে জানতে চাইলেন-ডিসি হিলে কি করতে চাচ্ছি সে বিষয়ে। তাকে পার্ক করতে চাই বললে তিনি বলেন, অন্য কোথাও করা যাবে না। তখন আমি তাকে বলি-‘‘অন্য জায়গা আছে, কিন্তু ডিসি হিল তো নেই। এটা চট্টগ্রামের মানুষের আত্মার জায়গা। আর আমরা তো এখানে বাড়িঘর করছি না। হাঁটার জায়গা করছি। ’’ তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেটি বুঝতে পেরেছিলেন। আমার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। ’
তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত রমনা পার্কে প্রাতভ্রমণে বের হই। সেখানে আগে ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা ছিল। দিনভর নানা অনুষ্ঠান হতো। আমি সব বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু ডিসি হিলে যখনই আসছি তখনই দেখছি। নোংরা। ’
ইয়োগার মুখের অনুশীলন টেনে তিনি হাসতে হাসতে বললেন-‘সবাই হা হা করে অনুশীলন করি। কিন্তু সেই সময় তো মুখে সব ময়লা ঢুকে যাবে। তাই নিজেদের সুরক্ষায় নিজেদেরকেই এই অঙ্গন পরিষ্কার রাখতে হবে। ’
কর্মসূচিতে মন্ত্রী চাপাফুল ও কাঠবাদাম সহ পাঁচটি চারাগাছ রোপন করেন।
এসময় বক্তব্য দেন কর্মসূচির অন্যতম উদ্যোক্তা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সুযত পাল।
তিনি বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না হলে স্বাস্থ্য সুন্দর হবে না, মনও হবে না পবিত্র। এজন্যই আমাদের এই উদ্যোগ। আমরা কারও দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই না। এজন্য এই কর্মসূচির নাম দিয়েছি-‘পরিচ্ছন্নতা নিজেরাই করি, কারও জন্য অপেক্ষা নয়। ’
নির্দিষ্ট জায়গায় না ফেলে এখানে ওখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় এখনও যখন ‘অভ্যস্ত’ রয়ে গেছে মানুষ-সেসময়ে ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে মন্ত্রীর ঝাড়ু হাতে নিয়ে পরিচ্ছন্নতায় নেমে পড়া- সবার কাছে বার্তা না গিয়ে কি উপায় আছে?
বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৭
টিএইচ/আইএসএ/টিসি