অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের হাতে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি সিম তুলে দিচ্ছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় কোনও ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই এসব সিম বিক্রি করতে দেখা গেছে।
মিয়ানমারের মংডুর ডিগইল্লা পাড়ার সুলতান আহমদের ছেলে মো. নুর (৩০) শনিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) তুমব্রু সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তিনি জানান, স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা দিয়ে সিমসহ মোবাইল সেট কিনেছেন।
কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ওসমান গনিকে সিম কিনতে কোন কাগজপত্র জমা দিতে হয়নি। কাগজপত্র ছাড়াই দোকান থেকেই সিম কিনেছেন তিনি।
উখিয়ার লম্বারবিল রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া শফিকুল মোস্তফা জানান, কুতুপালং বাজারের এক দোকান থেকে সিমসহ মেবাইল সেট কিনেছেন তিনি।
মংডুর চারখম্ব এলাকা থেকে কামাল হোসেন (২৫) নামে যুবক একসপ্তাহ আগে বাংলাদেশে এসেছেন। পরিবারের ৯ সদস্য নিয়ে কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্প সংলগ্ন আম গাছতলা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাকেও মোবাইলে কথা বলতে দেখা গেল।
মোবাইল ও সিম কেনার বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারেই আমার মোবাইল ছিল। বাংলাদেশে আসার পর একজনের কাছ থেকে ১৫০ টাকায় একটি সিম (রবি) কিনেছি। ’
কার কাছ থেকে সিম কিনছেন জানতে চাইলে বিক্রেতার নাম বা মোবাইল নম্বর দিতে পারেননি তিনি। তবে তিনি জানান, মূলত দালালরা গোপনে সিম ও মোবাইল প্যাকেজ আকারে বিক্রি করছেন। রোহিঙ্গারাও এর সুযোগ নিচ্ছেন।
মো. রহিম (২১) দশদিন আগে বাংলাদেশে এসে ১৫০ টাকায় একটি সিম (বাংলালিংক) কিনে ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, ‘পরিবারের সবাই হারিয়ে যায়, তাই মোবাইল দরকার। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে মোবাইল দরকার। ’
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে কামাল ও রহিমের মত শত শত রোহিঙ্গা পুরুষ ও নারীদের হাতে মোবাইল ফোন ও বাংলাদেশি সিম দেখা গেছে। অনেক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাফ নদীর উপকূলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি মোবাইল অপারেটরের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। অনেকে মিয়ানমারে বসেও বাংলাদেশের সিম ব্যবহার করেন।
মো. রফিক নামে এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘সীমান্তে একজনের কাছ থেকে ৫০০ টাকায় সিম (বাংলালিংক) কিনেছি। সীমান্তে অনেকে সিমসহ মোবাইল বিক্রি করছে। কোনও কাগজপত্র লাগে না। সিম খুব ভালোই চলছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, শরণার্থী হয়ে আসা রোহিঙ্গারা হাতে, পকেটে, গলায় ঝুলিয়ে রাখছে মোবাইল। নারীরাও মোবাইল ব্যবহার করছেন। তারা মোবাইল অপারেট করতেও পারদর্শী। মোবাইল নম্বর মুখস্ত না থাকায় সংখ্যা ডায়েল করে মোবাইল নম্বর বের করে দিতে পারেন। এছাড়া কুতুপালংয়ের রাস্তায় ত্রাণের জন্য বসে থাকা নারীদেরও মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায়।
নূর কামাল হোসেন (৩০) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক বলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডংয়ে কোয়ারবিল এলাকায় আমাদের বাড়ি। বাবা-মা ও ভাইবোনসহ মোট ৯ জন বাংলাদেশে এসেছি। একটি মোবাইল ও সিম (বাংলালিংক) ৫২০০ টাকায় কিনেছি। কুতুপালংয়ের বাজারের একটি দোকান থেকে সিমটি দুইশ টাকায় কিনেছি। সিম কিনতে কোনও কাগজপত্র লাগেনি। ’
মংডুর চাইরকম্ব এলাকা থেকে বাংলাদেশে এসেছেন ইসমাইল হোসেন (১৪)। তার পরিবারের ৮ জন কুতুপালং নতুন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তার হাতেও মোবাইল ফোন দেখা গেল। তিনি বলেন, ‘নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপে প্রথমে একদিন ছিলাম। সেখান এক ব্যক্তির কাছ থেকে সিমটি (রবি) কিনে নিয়েছি। সিম কেনার সময় বিক্রেতা কোনও কাগজপত্র চাননি। ’
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনের সড়কেই অনেকগুলো মোবাইল সার্ভিসিং ও রিচার্জের দোকান রয়েছে। যেখান থেকে রোহিঙ্গারা সিম কিনছেন। কুতুপালংয়ের আমগাছ তলা ক্যাম্পের সামনের একটি দোকানে ভিড় দেখে সেখানে গেলে দেখা যায়, রোহিঙ্গা যুবকরা মোবাইলে রিচার্জ করছেন, কেউ গান নিচ্ছেন, কেউ সিম কিনছেন। মোবাইল খুলে সিম সংযোগ করে দিচ্ছেন দোকানি।
এসময় জানতে চাইলে সিম বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন দোকানি জুয়েল।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড.একে এম ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি সিম ব্যবহার করছে এটা জানা নেই। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এভাবে সিম বিক্রি হলে আইনশৃংখলার অবনতি হতে পারে। নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে। স্থানীয়রা নিজেদের নামে সিম কিনে রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করছে বলে ধারণা করেন তিনি।
এ বিষয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘এগুলো নজরদারির জন্য মোবাইল অপারেটরদের নিজস্ব প্রক্রিয়া রয়েছে। তারপরও আমরা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। ’
গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ২৯টি চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে। রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগ, বোমা নিক্ষেপ, গুলি করে ও গলা কেটে রোহিঙ্গাদের হত্যার অভিযোগ উঠে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে আসা শুরু করে। এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই সংখ্যা দশ লাখ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাগুলো।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৭
আইএসএ/টিসি