মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও কক্সবাজার ডিজিটাল হাসপাতাল ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
সূত্রমতে, কক্সবাজার ডিজিটাল হাসপাতালে জাতিসংঘের সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল মেডিসিন স্যঁ ফ্রঁতিয়ে’র (এমএসএফ) তত্ত্বাবধানে ১৭ জন রোগী বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এমএসএফ ও আইওএম এর তত্ত্বাবধানে গত ২৮ আগস্ট থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮০ জন রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ।
মঙ্গলবার কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মোট ৪৮ জন রোহিঙ্গা ভর্তি ছিল।
মিয়ানমারের মংডুর মগনামা থেকে আসা নূরুল আমিন (৩৫) পেটে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কক্সবাজার ডিজিটাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নূরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, কোরবানির ঈদের তিনদিন আগে চলে এসেছি। পুলিশ-মিলিটারি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পাড়ায় ঢুকেছিল। আমি পালাতে গিয়ে গুলি লেগেছে। তাড়াতাড়ি নৌকায় তুলে আমাকে বাংলাদেশে না আনলে আমি মারা যেতাম।
নূরুল আমিনের স্ত্রী-ছেলেমেয়েসহ পাঁচজন এখন আছেন টেকনাফের লেদা এলাকায়।
মিয়ানমারের মংডুর সফরদিঘী এলাকার মো.হাশিমের (১৭) ডান হাতে গুলি লেগেছে। গুলিবিদ্ধ হাত নিয়ে তিনদিন পর হাশিমকে নিয়ে আসা হয় ডিজিটাল হাসপাতালে। হাশিমের সেই হাতটি এখন পঁচে যাবার উপক্রম হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে চিৎকার করে কেঁদে উঠছেন হাশিম। তিনি বলেন, যদি সেখানেই আমাকে মেরে ফেলত অনেক ভালো হত। কেন যে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখল।
বাম হাতে গুলি লাগার পর গুরুতর আহত ফরিদ আলমকে (১৬) মংডুর সাহেববাজার থেকে কোরবানির দিন এনে প্রথমে উখিয়ায় কুতুপালং স্বাস্থ্যক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেখান থেকে এমএসএফ সদস্যরা তাকে ডিজিটাল হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আহত ফরিদও হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন।
মংডুর বলিবাজার হোয়াইক্যং থেকে আসা জোহরা বেগমের (১৩) ডান পায়ে গুলি লেগেছে। জোহরার বড় ভাই মো. নূর বাংলানিউজকে বলেন, গত শনিবার আমাদের পাড়ায় আর্মি ও পুলিশ মিলে গুলি করে। আমাদের ঘরে আগুন দিয়েছে। আমার বোনকে ভেতরে রেখেই আগুন ধরিয়ে দেয়। সে বের হতে গিয়ে গুলি লাগে।
মংডুর মইন্যাপাড়ার সাত বছরের শিশু নূর হাসানও গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে। তার মা রেহানা বেগম বলেন, ছেলেটা ঘরে আসছিল। পথে আর্মি পেয়ে গুলি করে দিয়েছে। আমার আরও দুইটা ছেলে আছে। তাদের ফেলেই চলে এসেছি। এখানে এসেছি বলে ছেলেটাকে বাঁচাতে পেরেছি।
মিয়ানমারের ভুচিদং থেকে আসা আবদুল্লাহর বাম পায়ে গুলি লেগেছে। গুলিবিদ্ধ আবদুল্লাহ ডিজিটাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আবদুল্লাহর বাবা আব্দুল মালেক বলেন, আমার ছেলেটাকে তিনজনে মিলে বাঁশের খাঁচা তৈরি করে তারপর টেকনাফ দিয়ে এনেছি। যন্ত্রণায় সে ছটফট করেছে। এখনও ছটফট করছে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গাদের জন্য তিন কক্ষবিশিষ্ট আলাদা একটি ব্লক তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. পু চ নু বাংলানিউজকে বলেন, সর্বোচ্চ মানবিকতা দিয়ে আমরা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দিচ্ছি। বহির্বিভাগে আলাদা ব্লক করেছি অপারেশন থিয়েটারের পাশে। কারণ দ্রুত যাতে ড্রেসিং করা যায়। এসব রোগীদের তো যেভাবে হোক আমাদের সুস্থ করে তুলতে হবে।
মংডু জেলার শীতরিক্ষ্যা থেকে আসা এনায়েত উল্লাহর (১৮) ডান পায়ের পাতায় গুলি লেগেছে। এনায়েত বাংলানিউজকে বলেন, আর্মি ঝড়ের মতো গুলি করছিল। আমি দৌড়াতে গিয়ে পড়ে যাই। এরপর আমার পায়ে গুলি লাগে।
মংডুর সাইরাপাড়া থেকে আসা সৈয়দ উল্লাহর (২০) পিঠে গুলি লেগেছে। ঠিকমতো শুতে পারছেন না সৈয়দ। অসহ্য যন্ত্রণায় তাকে কাতরাতে দেখা গেছে হাসপাতালের বেডে।
মংডুর রাচিদংয়ের কুঞ্জারপাড়া থেকে আসা জেলে ইমান হোসেনেরও ডান পায়ে গুলি লেগেছে। ইমান বাংলানিউজকে বলেন, বাড়িতে আগুন দিচ্ছিল। আমি যখন ছুটে গেলাম তখন আমাকে ধরে পায়ে গুলি করে দিল।
মংডুর শিলখালী থেকে আসা মোহাম্মদ উল্লাহর পেটে গুলি লেগে গুরুতর আহত হয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি জানালেন, তার ঘরে ঢুকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়েছে। আহত অবস্থায় তাকে কয়েকজন মিলে নাফ নদী দিয়ে টেকনাফে এনে হাসপাতালে নিয়ে যায়। স্ত্রী-সন্তানরা কোথায় আছে, এখনও জানেন না তিনি।
মিয়ামনারের রাচিদং থেকে আসা ১৫ বছর বয়সী জমিলার বাম হাতের উপরে গুলি লাগে। সেই গুলি বেরিয়ে যায় ঘাড় দিয়ে। গুরুতর আহত জমিলাকে প্রশ্ন করলেই তার চোখ দিয়ে গড়ায় পানি। নৃশংসতার দুঃসহ স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে মিয়ানমারে সেনা চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সহিংসতার মুখে টিকতে না পেরে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দলে দলে আসছেন বাংলাদেশে।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী এই পর্যন্ত বাংলাদেশে সোয়া তিন লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। তবে স্থানীয়দের মতে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৭
আরডিজি/আইএসএ/টিসি
ধানখেতে পড়ে ছিলেন তসলিমা, বুকে দুই সন্তানের নিথর দেহ
এত রোহিঙ্গা শিশুর ভবিষ্যৎ কি ?
মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নন নির্যাতিত রোহিঙ্গারা
পথে পথে তল্লাশি, রোহিঙ্গাদের সতর্কে মাইকিং
রোহিঙ্গাঢলে হুমকির মুখে পর্যটন শিল্প
কত রোহিঙ্গা এসেছে, সঠিক হিসেব নেই কারো কাছে
সক্রিয় দালালচক্র, পুঁজি রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ
রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ৪ চেকপোস্ট
পাহাড়-বন দখল করে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের বসতি
‘ওপারে বাদশা ছিলাম, এপারে ফকির হলাম’
মঙ্গলবারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের মায়ানমার ছাড়ার আলটিমেটাম
স্ত্রীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে স্বামীরা