ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নন নির্যাতিত রোহিঙ্গারা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৭
মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নন নির্যাতিত রোহিঙ্গারা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে: পিতা-মাতার সামনে সন্তান কিংবা স্ত্রীর সামনে স্বামীকে নৃশংসভাবে খুন। কাউকে গলা কেটে, কাউকে গুলি করে। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ আর গ্রামের পর গ্রাম, ভিটেমাটি জ্বালিয়ে দেওয়া। প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারপর এক কাপড়ে কোলের সন্তান নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। 

কেউ সাতদিন, কেউ চারদিন আর কেউ ১৫-১৬ দিন পায়ে হেঁটে মিয়ানমারের সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন। মিয়ানমারে চরম সহিসংসতার শিকার হয়ে শরণার্থী হয়ে যাবার এই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করছে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের।

পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি হারিয়ে মানবিকতার চরম বিপর্যয়ে পড়া রোহিঙ্গারা সেই দুঃসহ অতীতে আর ফিরতে চান না।  

জন্মভূমি মিয়ানমার তাদের কাছে এখন নির্মমতার জনপদ।

তারা আর কোনোভাবেই ফিরতে রাজি নন সেই জনপদে। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার সীমান্ত প্রায় খুলে দিয়েছে। তবে পরে তাদের ফেরত পাঠানোর কথাও এসেছে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে।  

বাস্তু-ভিটা ফেলে ও পরিবার-পরিজন হারিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন রোহিঙ্গারা।  ছবি: বাংলানিউজকিন্তু মিয়ানমার বলছে, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কাউকে তারা মিয়ানমারে ঢুকতে দেবে না। রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া ঠেকাতে সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখার কথাও এসেছে গণমাধ্যমে। তবে সরকারি মহলে যা-ই কথা হোক, রোহিঙ্গারা যে আর মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নন, সেই বক্তব্যই পাওয়া গেছে উখিয়ার কুতপালং এলাকায় অস্থায়ী বসতি গড়ে বসবাস করা নারী-পুরুষদের কথায়।  

তাদের অনেকের বক্তব্য এমন, ‘মরতে হলে মুসলমান দেশে মুসলমানের হাতে মরবো, কোনোভাবে মগের হাতে নয়। ’ 

সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) কুতপালং মূল শরণার্থী ক্যাম্পের পাশে অস্থায়ী ক্যাম্পে বসতি গড়ে বসবাসকারী সিব্বির আহমেদের সঙ্গে কথা হয়। মিয়ানমারের মংডু জেলার বলিবাজার থেকে আসা সিব্বির মিয়ানমারে নির্মমতার বর্ণনা তুলে ধরেন এভাবে, ‘আমার চোখের সামনে আমার বড় ছেলে শহীদ হয়েছে। ওরা যখন গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছিল, আমরা তখন নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর বলে লাঠিসোঠা, দা-কিরিচ নিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি। কিন্তু গুলির মুখে টিকতে না পেরে পিছিয়ে যাই। তখন মগরা এসে যাকে সামনে পেয়েছে তার গলা কেটে দিয়েছে। আমার ছেলেরও গলা কেটে দিয়েছে। ’ 

সহায় সম্বল ফেলে প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন রোহিঙ্গারা।  ছবি: বাংলানিউজ

‘এক কাপড়ে চলে এসেছি। ছেলেটারে দাফনও করতে পারিনি। আর কোনদিন ফিরতে পারব কি না জানি না। ফেরার ইচ্ছাও নেই। ’ এভাবেই বলছিলেন মংডু জেলার ছেরাউ থেকে স্ত্রী ও তিন ছেলেকে নিয়ে এসেছেন মাদ্রাসা শিক্ষক মৌলভী মো. সেলিম।  

তিনি বাংলানিউজেকে বলেন, আমরা যুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের কাছে অস্ত্র ছিল না। আলেকিনের (বিচ্ছিন্নতাবাদী রোহিঙ্গাদের সংগঠন) কাছেও অস্ত্র ছিল না। তারা ২-১ দিন যুদ্ধ করে তারপর পাহাড়ে ঢুকে গেছে। কয়েকজন আলেকিন বাংলাদেশে চলে এসেছে।  

‘আমাদের ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে (মিয়ানমার) গিয়ে আর আমাদের কি হবে ? এখানেই থাকবো। এখান থেকে যদি বের করে দেয় তখন যাবো,’ বলেন মৌলভী সেলিম পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে মংডু জেলার মগনামা থেকে এসেছেন সেখানকার একটি মসজিদের ইমাম ফৌজি আলম।  

তিনি বলেন, মুসলমান দেখলেই মগরা কেটে ফেলছে। সেনাবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলছে। সেখানে যখন মগদের জন্য থাকতে পারছি না, তখন মুসলিম দেশে এসেছি। মরতে হলে মুসলমানের দেশে মুসলমানদের হাতে মরবো। মগদের হাতে মরবো না।  

মংডু জেলার ভুচিদং টমবাজার এলাকায় এসিএফ-মিয়ানমার নামে একটি এনজিওতে ওয়াচম্যান হিসেবে কাজ করতেন হাবিবুর রহমান। স্ত্রী-সন্তানসহ ১২ জন নিয়ে বাংলাদেশে আসা হাবিবুর বাংলানিউজকে বলেন, আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। সেখানে যেতে বেশি ভয় লাগছে।  

মংডুর পুন্দপরাং গ্রাম থেকে আসা শুক্কুর বাংলানিউজকে বলেন, ঘরবাড়ি, জমির ফসল, গরু-মহিষ সব ফেলে চলে এসেছি। শুনেছি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি ঠিক হলে চলে যাবার ইচ্ছা আছে। ফসল তুলতে হবে। তবে ভাবছি কেমনে যাবো? গেলে যদি কেটে ফেলে! 
খোলা আকাশের নিচে কিংবা ঝুপড়িতে থাকছেন রোহিঙ্গারা।  ছবি: বাংলানিউজএকই গ্রাম থেকে আসা রশিদ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, পরিস্থিতি ঠিক হলেও আর বার্মায় যাবো না। মগরা সেখানে কোনো মুসলমান রাখবে না। আমার দুই ভাইকে চোখের সামনে কেটে ফেলেছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি মরতে হলে মুসলমানের দেশে গিয়ে মরবো।  

মিয়ানমারে সেনাচৌকি ও চেকপোস্টে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর গত ২৩ আগস্ট থেকে সেখানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছেন রোহিঙ্গারা। অনুপ্রবেশের স্রোত এখনও অব্যাহত আছে। কি পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তার সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই। তবে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে বলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে।

আরও পড়ুন
**
ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে শিশু
**রোহিঙ্গাঢলে হুমকির মুখে পর্যটন শিল্প
**কত রোহিঙ্গা এসেছে, সঠিক হিসেব নেই কারো কাছে
**
সক্রিয় দালালচক্র, পুঁজি রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ
**রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ৪ চেকপোস্ট
**‘ওপারে বাদশা ছিলাম, এপারে ফকির হলাম’
**পাহাড়-বন দখল করে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের বসতি
**‘ওপারে বাদশা ছিলাম, এপারে ফকির হলাম’
**মঙ্গলবারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের মায়ানমার ছাড়ার আলটিমেটাম
**স্ত্রীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে স্বামীরা
**গাড়ি দেখলেই রোহিঙ্গাদের আর্তি ‘খাবার দিন’
**মাকে কাঁধে নিয়ে ২৯ মাইল হেঁটে এপারে সাইফুল্লাহ

 বাংলাদেশ সময়: ০৬৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১২,২০১৭ 
আরডিজি/আইএসএ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।