ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

পাহাড়-বন দখল করে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের বসতি

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭
পাহাড়-বন দখল করে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের বসতি দুই পাহাড়ের মাঝে হাতি পারাপারের স্থানেও বসতি তুলে আশ্রয় নিয়েছেন রোহিঙ্গারা। ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে: কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের কয়েক হাজার একর সবুজ পাহাড় দখল করে বসতি গড়ে তুলছেন মিয়ানমার থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গারা। নির্বিচারে পাহাড়, গাছপালাসহ সবুজ বনাঞ্চল উজাড় করা হচ্ছে। পাহাড় দখলের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বন্যহাতির অভয়ারণ্য এসব পাহাড়।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরুর পর ৪০০ একর বনভূমি দখলের তথ্য তারা পেয়েছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও বনভূমি দখলের পরিমাণ এত বেড়ে গেছে যে, কী পরিমাণ পাহাড় ও বনাঞ্চল দখল হয়ে গেছে তার সঠিক হিসাব নিরুপণ করা যায়নি।

এই অবস্থায় কক্সবাজারে ভূমিধসসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উপ বন সংরক্ষক মো.আলী কবির বাংলানিউজকে বলেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর আমরা একটা জরিপ করেছিলাম।

প্রায় ৪০০ একর বনে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ আছে। গত এক সপ্তাহে রোহিঙ্গা আসা এমনভাবে শুরু হয়েছে যে দুর্যোগ সামাল দেওয়াই কষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থায় জরিপ অসম্ভব।

সূত্রমতে, উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, বালুখালী, বালুখালীঢালার প্রায় সব পাহাড় ও টিলা দখল হয়ে গেছে। প্রাথমিক হিসেবে বড় পাহাড়ের পরিমাণ ২৫টিরও বেশি।

টেকনাফ উপজেলার উনচিপ্রাং পুটিয়া, চিকনছড়া মগরারবিল ও তানজিমাঘোনা এলাকার হাজারেরও বেশি একর বনাঞ্চল দখল করে অবস্থান নিয়েছেন রোহিঙ্গারা।

টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা মিলে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই হাজার একর বনভূমি এখন রোহিঙ্গাদের দখলে আছে বলে বন বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রাথমিক হিসাব দিয়েছেন।

রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) উখিয়ার কুতুপালং আমতল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মূল সড়কের আশপাশে বাঁশের মাচা এবং ত্রিপল দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত বসতি। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলা সড়কের বিভিন্ন স্থানে ‘হাতি পারাপারের স্থান’ সাইনবোর্ড দেওয়া আছে। গাড়ি এবং লোকজনকে সাবধানে চলাচলের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু সেই সাইনবোর্ডগুলোর নিচেও বসতি তুলে আশ্রয় নিয়েছেন রোহিঙ্গারা।

এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে ঢুকে কুতুপালং এলাকায় আশ্রয় নেওয়া নূর বানু বাংলানিউজকে বলেন, পালংখালী দিয়ে ঢোকার পর আমরা কুতুপালং এসেছি। আমাদের বলা হয়েছিল, এখানে খালি জায়গা আছে। খালি জায়গা পেয়ে ঘর করেছি।

বন কর্মকর্তা মো.আলী কবির বাংলানিউজকে বলেন, উখিয়া-টেকনাফসহ কক্সবাজারের বনাঞ্চলগুলো হাতির আবাসস্থল। হাতি খাবারের সন্ধানে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়া-আসা করে শুধু নির্দিষ্ট রুট দিয়ে। তারা কখনো রুট পরিবর্তন করে না। হাতি পারাপারের স্থানে যারা আশ্রয় নিয়েছে তাদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে আছে। যে কোনসময় হাতি আক্রমণ করতে পারে। পাহাড়-বন দখল করে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের বসতি

গত শুক্রবার উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় বন্যহাতির পদপিষ্ট হয়ে একজন রোহিঙ্গা মারা গেছেন বলে বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

উখিয়ার বালুখালী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে সুউচ্চ পাহাড়চূড়া কেটে বসতি তৈরির ধুম পড়েছে। পাহাড়ের খাঁজ কেটে সমতল করে গড়ে তেলা হচ্ছে বসতি। প্রতিটি বসতির আশপাশে বন বিভাগের গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। উঁচু গাছ কেটে অনেকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছেন।

সূত্রমতে, টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকটি সিন্ডিকেট পাহাড়ে-বনাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের পুর্নবাসনে কাজ করছে। পাহাড়ে জায়গা দিয়ে ঘর তৈরির ব্যবস্থা করে দিয়ে তারা প্রতি পরিবারের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে।

বন কর্মকর্তা মো.আলী কবির বাংলানিউজকে বলেন, প্রথম যে ক্ষতিটা হচ্ছে সবুজ পাহাড়গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে পাহাড় কাটা চলছে তাতে ভূমিধসের সম্ভাবনা সৃষ্টি হচ্ছে। হাতির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেগুলো লোকালয়ে চলে আসবে। পরিবেশগত এবং প্রাকৃতিক একটা বিপর্যয় সৃষ্টির আশঙ্কা আছে।

এদিকে বনাঞ্চলের গাছ কেটে ফেলায় বিপাকে পড়েছেন বন বিভাগের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সামাজিক বনায়নে অংশ নেওয়া ব্যক্তিমালিকরা। তারা জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের পাহাড় থেকে সরিয়ে দেওয়া অথবা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বন বিভাগের কাছে আবেদন করেছেন। বন বিভাগ বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছে।

সূত্রমতে, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ পাওয়া ৭৫ জন অংশীদার গত ২৩ আগস্ট বন বিভাগের কাছে আবেদন করেন। এতে তারা উখিয়া উপজেলার ঘাটবন বিটের আওতায় তাদের ৩০ হেক্টর বনভূমি রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে বলে জানিয়েছেন। এই বনভূমিতে ৪ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে বলেও তারা আবেদনে উল্লেখ করেছেন।

এই অবস্থায় জেলা প্রশাসন উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীতে দেড় হাজার একর পাহাড়ি এলাকা ঘিরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখার পরিকল্পনা করছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্ম্মা দীপু বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বন ও পাহাড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করা উচিৎ হবে না। যেসব রোহিঙ্গা বনাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে তাদের সরিয়ে নেওয়া উচিৎ। যেভাবে পাহাড় কেটে ও বন দখল করে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে তাতে অচিরেই বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭

আরডিজি/আইএসএ/টিসি

‘ওপারে বাদশা ছিলাম, এপারে ফকির হলাম’

রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ৪ চেকপোস্ট

মঙ্গলবারের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের মায়ানমার ছাড়ার আলটিমেটাম

স্ত্রীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে স্বামীরা

গাড়ি দেখলেই রোহিঙ্গাদের আর্তি ‘খাবার দিন’

মাকে কাঁধে নিয়ে ২৯ মাইল হেঁটে এপারে সাইফুল্লাহ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।