ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

‘সমন্বয় হলে সমস্যা সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৭
‘সমন্বয় হলে সমস্যা সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র’ ‘উন্নয়নের মহাসড়কে চট্টগ্রাম, নাগরিক দুর্ভোগ, সমন্বয় ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা

চট্টগ্রাম: পরিকল্পিত নগরীর জন্য সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় অবশ্যই প্রয়োজন উল্লেখ করে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, কাঙ্ক্ষিত সমন্বয় হলে জলাবদ্ধতা, যানজটসহ যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছি তা সমাধান হবে এবং ভবিষ্যতেও নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে না। সমন্বয় হলে সমস্যাগুলোর সমাধান সময়ের ব্যাপার মাত্র।

রোববার (২২ আগস্ট) সকালে রেডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউতে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে চট্টগ্রাম, নাগরিক দুর্ভোগ, সমন্বয় ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় মেয়র এ মন্তব্য করেন। অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম আয়োজিত এ আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন।

সঞ্চালনা করেন বাংলানিউজের ব্যুরো এডিটর তপন চক্রবর্তী।

সুসমন্বয়ের লক্ষ্যে দেশের প্রাচীনতম দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এমএ মালেককে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামসহ সব সংস্থার প্রধানকে নিয়ে একটি সভা আয়োজনের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানান মেয়র।

এর প্রেক্ষিতে দৈনিক আজাদী ও চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) যৌথ উদ্যোগে এ ধরনের একটি সভা করবেন বলে জানান আজাদী সম্পাদক।

জলাবদ্ধতা এবার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে জানিয়ে মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন বাইর থেকে যতটা সহজ মনে হয় আসলে তত সহজ নয়। ১৯৬০ সাল থেকে জলাবদ্ধতা হচ্ছে চট্টগ্রামে। এটাকে অবশ্যই সমাধান করতে হবে। কোনো সমস্যাকে খাটো করার পক্ষপাতি নই। বর্তমানে নগরীর ৭ শতাংশ এলাকা জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বশেষ পাওয়ার চায়নার স্টাডিতে এটা জানা গেছে। আমার মনগড়া কথা নয়। এখনি সমাধানের উদ্যোগ না নিলে সমস্যা বাড়তেই হবে। কষ্ট ও দুঃখের বিষয় হচ্ছে একসময় আমাকেও দায়ী করা হবে।

তিনি বলেন, নগরে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। তাই সুপরিকল্পনা গ্রহণ করবে কে? চসিকের এ সক্ষমতা নেই। চট্টগ্রামের কোনো সংস্থার এ সক্ষমতা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কাজ করতে হবে।

মেয়র বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য চট্টগ্রামের এ অবস্থা হয়েছে। এটি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। চট্টগ্রামে আপাতত সুফল পাওয়ার মানসিকতায় অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে সেগুলো বুমেরাং হয়েছে। এখন চট্টগ্রাম যে জায়গায় চলে এসেছে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে এখনই। সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। এখনই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। কোন সংস্থা কতটুকু বাস্তবায়ন করবে তা-ও চিহ্নিত করতে হবে।

আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নগরীর বিউটিফিকেশন, আধুনিক যাত্রীছাউনি, এলইডি লাইটিং, ৬০০ সড়কের সংস্কারসহ অনেক কাজ দৃশ্যমান হবে বলে জানান মেয়র।

বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন বলেন, চট্টগ্রামের আকাশে মেঘ দেখলেই সড়কে নৌকা-মানুষের মনে এমনটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিছুদিন পর হয়তো সড়কে শিপও চলে আসবে। এর উত্তরণে জনপ্রতিনিধিদেরই সম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ যারা জনপ্রতিনিধি নন তারা সেভাবে কাজ নিয়ে এগোবে না।

তিনি মেয়রকে ইঙ্গিত বলেন, আপনি বয়সে তরুণ। আপনি আরও অনেকবার নির্বাচিত হবেন। আমি আশা করবো লেগে থেকেই আপনি আমার ভালোবাসার এ শহরের সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন। কারণ এটা বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশের দ্বিতীয় বড় শহর।
সুপ্রভাত বাংলাদেশ সম্পাদক রুশো মাহমুদ বলেন, জলাবদ্ধতা এ সময়ের সবচেয়ে বড় সংকট, প্রধান সমস্যা। জলাবদ্ধতা নিরসনে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, পাউবোর কনসোর্টিয়াম না গড়লে আখেরে ভালো ফল আসবে না।

তিনি বলেন, একসময় চট্টগ্রাম শহরে ৭০টি খাল ছিল। এখন আছে ৩৭টি। জলাবদ্ধতার কারণ বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথ নেই। খাল উদ্ধার হলে, জোয়ারের পানি ঠেকানো গেলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে। নগরীর দ্বিতীয় সমস্যা যানজট। নগরীতে যেসব গাড়ি চলে তার ৯০ শতাংশ ছোট গাড়ি; রিকশা, অটোরিকশা, কার ইত্যাদি। এসব গাড়ি পরিবহন করে মাত্র ৩০ ভাগ যাত্রী। অন্যদিকে গণপরিবহন আছে মাত্র ৮ শতাংশ। গণপরিবহনের কথা চিন্তা না করে আমরা করছি ফ্লাইওভার।

একুশে টেলিভিশনের আবাসিক সম্পাদক রফিকুল বাহার বলেন, নগরীতে যানজট, জলজটসহ সব সংকটের পেছনে আছে রাজনীতি। রাজনীতিই একমাত্র দায়ী।

মেয়রকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, জনগণ আপনাকে ভোট দিয়ে মেয়র বানিয়েছে। আপনি তিনটি সংসদীয় আসনের নির্বাচিত প্রতিনিধি। ধমক দেন। ডেকে বলেন, আমি বলছি, এটা করতে হবে। ডিক্টেটর হোন। ৫টি মিডিয়া আপনার বিরুদ্ধে লিখবে, ১৫টি পক্ষে লিখবে। সবাইকে ডাকেন, ধমকান। বিশ্বমানের শহরে দুই লাখ রিকশার অনুমোদন কেন দেওয়া হলো? রাস্তার তো সক্ষমতা নেই। এত বাস, ট্রাক, গাড়ি আর গাড়ি, ম্যানেজমেন্ট কোথায়?

প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, জলজট সমাধানযোগ্য। একেবারেই সমাধানযোগ্য। স্টাডি আছে। প্রেসক্রিপশনও আছে। তবে সিডিএ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে আর সিটি করপোরেশন মেইনটেন্যান্স করবে, এটা করলে হবে না। এটা বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টি করবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যদি নিতে হয় তো একেবারেই সিডিএ নিয়ে যাক।

তিনি বলেন, জলজট নিয়ে একটা বড় প্রকল্প সিডিএ পাস করিয়েছে। আমরা এতে খুব সন্তুষ্ট। কিন্তু ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানে যেসব প্রায়োরিটির কথা আছে সেগুলো এখানে খুব দৃশ্যমান নয়। সেজন্য প্রশ্ন আসছে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার অপচয় হয় কি না।

চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বন্দরের সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা সাফার করবে কেন?  দুই মাস আগে দুটি গ্যান্ট্রি ক্রেন অচল হয়েছে, অথচ এখনো সচল হয়নি। তবে সম্প্রতি ছয়টি গ্যান্ট্রি ক্রেন কেনার অনুমোদন দিয়েছে। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের উন্নয়নে অনেক বড় বড় প্রকল্প দিয়েছেন। কথা হলো সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে এবং গভীর সমুদ্রবন্দরের বিকল্প হিসেবে দ্রুত বে-টার্মিনাল নির্মাণের দাবি জানান তিনি।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের যাত্রা শুরু। তখন ছিল ৭ লাখ মানুষ, বর্তমানে ৬০-৭০ লাখ মানুষ। কিন্তু তখনকার তুলনায় এখন সড়ক বাড়েনি। তখন আমাদের আওতাভুক্ত ছিল ৬০ বর্গকিলোমিটার জায়গা আর এখন ১৫২ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু সে পরিমাণে আমাদের লোকবল বাড়েনি। তখন ছিল ৩৯৫ জন, এখন ৯৫৫ জন জনবল। সার্জেন্ট দরকার আমাদের ২০৯ জন, আছে ১২১ জন। এর ফলে সড়কে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। কারণ ১৯৭৮ সালে ৩০ হাজার গাড়ি ছিল। কিন্তু এখন মোটরবাহী গাড়িই আছে আড়াই লাখ। একটা সড়কের ওপর গাড়িই চলে ১৯ ধরনের।

চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল আফছার বলেন, নগরীতে একযোগে অনেক উন্নয়নকাজ চলছে। তাই নগরবাসীকে কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ দুর্ভোগ কমাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সমন্বয় বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নগরীতে ওয়াসার চলমান প্রকল্পগুলো কিছুদিনের মধ্যে শেষ হবে।  

আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম বলেন, নগরীর খাল-নালা-নদী দখল করে ভবন নির্মাণ করায় জলাবদ্ধতা ও সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ির কারণে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। একটি রাস্তা তৈরির পরপরই যখন কাটতে দেখি তখন বুকটা ধক করে ওঠে। পরিবেশের জন্য দায়ী নগরবাসী। সিডিএর অনুমোদন ছাড়া নালার ওপর ভবন কেমনে হলো।

পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার যে মেগা প্রকল্প দিয়েছে তার কাজ যথাসময়ে শেষ করতে হবে। দুই বছরের প্রকল্প শেষ করতে যেন ৩০ বছর না লাগে।   এ প্রকল্প বাস্তবয়নে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, পাউবোর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে, তাহলে নগরবাসী সুফল পাবে।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৭, ২০১৭

এআর/টিসি

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।