ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

প্রতি মানুষের ‘দাম’ ৭০০ টাকা !

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৭
প্রতি মানুষের ‘দাম’ ৭০০ টাকা ! ‘বিক্রির’ অপেক্ষায় শ্রমিকরা। ছবি: বাংলানিউজ

চট্টগ্রাম: কোমরে পেঁচানো গামছা, কারও আবার মাথায়। হাতে কোদাল, ঝুঁড়ি-আরও কতো কী? একটু পর পর মালিক-কর্তা গোছের কিছু মানুষ আসছেন-আর তাদের কিনে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। দাম উঠছে প্রতিজন ৬০০ থেকে ৭০০টাকা; কাজের সময় সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা।

মানুষগুলোর নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। পুরনো ভবন ভাঙা থেকে নতুন ভবন তোলা, ইট বহন করা থেকে ইট ভাঙা-দিনের ওই ৮-৯ ঘণ্টায় তারা সব কাজই করতে পারেন।

এই শ্রমিকদের সবার আলাদা আলাদা নাম আছে, তবে ‘ডাকনাম’ সবার ওই একই-দিনমজুর।

নগরীর চকবাজার কাঁচা বাজার মোড়ে বিভিন্ন দোকানের সামনের ছোট্ট ছোট্ট জায়গায় শ্রমিকদের জটলার এই দৃশ্য সপ্তাহের সাতদিনের।

রাতের অন্ধকার কেটে যাওয়ার আগেই শুরু হয় অঘোষিত মানুষ ‘বিক্রির’ হাট। একেবারে পন্যের মত দর কষাকষিতে বিক্রি হন শ্রমিকরা। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই হাট।

এই হাট চলে সকাল ১০টা পর্যন্ত। এরপর ভেঙে যায় হাট। যারা বিক্রি হন তারা চলে যান কাজে। যারা অবিক্রিত থেকে যান তারা ফেরেন ঘরে। পরেরদিন আবারও শরিরগুলো দাঁড়িয়ে যায় বিক্রির জন্য-ওই একই ঠিকানায়।

শুক্রবার (১৮ আগস্ট) সকালে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মালিক-শ্রমিকদের দরদামের হাঁক শোনা যায়।

কথা হয় বিদ্যুৎ নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। বয়স সবে ২০ পেরিয়েছে। ঠোঁটের ওপর লোমের রেখা এখনও প্রায় অদৃশ্য। কিন্তু এই বয়সেই বিদ্যুদের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া যায় ইট ভাঙা থেকে, নির্মাণ শ্রমিকের সহকারির কাজ-তার দাবিটা অন্তত এমনই।

বলেন, ‘আমি মোটামুটি সব কাজ করতে পারি। প্রায় একবছর ধরে এখানে এসে কাজ খুঁজে নিই। ’

‘আমার বাড়ি ভোলা জেলায়। তবে চট্টগ্রাম শহরের রাহাত্তারপুল এলাকায় মা-বাবা ভাই-বোনদের নিয়ে থাকি অনেকদিন ধরে। পরিবারকে সহায়তা করতে হয়। আবার এদিকে আমার বিয়ের কথা চলছে। তাই নিয়মিত কাজের জন্য আসছি। বিয়ের জন্য টাকা জমানো জরুরি। ’-গালভরা হাসি নিয়ে বলেন বিদ্যুৎ।

শরিফুল ইসলাম এসেছেন উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলা থেকে। তিন সন্তানের জনক শরিফুলের পরিবার থাকে সেখানেই। তিনি এসেছেন বেশ কিছুদিন আগে। তারপর একজনের মাধ্যমে এখানে এসে কাজ খুঁজে নেন। শ্রমিক ‘কিনতে’ এসেছেন এক মালিক।  তাকে ঘিরে ধরেছেন শ্রমিকরা

শরিফুলের চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। সাম্প্রতিক বন্যায় তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরিবারের অবস্থা তেমন ভালো যাচ্ছে না। তাই তাকে নিয়মিত কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হচ্ছে।

শরিফুল বলেন, ‘বন্যার কারণে ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। তবে অন্যান্য এলাকার চেয়ে মোটামুটি কম। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের কষ্ট বেড়েছে। তাই আমাকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু টাকা জমাতে পারলে বাড়ি ফিরবো। ’

শ্রমিকদের কথা তো বলা হলো। কথা হলো যারা তাদের ‘কিনতে’ আসেন তাদের একজন দিদারুল ইসলামের সঙ্গে। চকবাজার ডিসি রোড এলাকার এই স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের নিজেদের তিনতলা ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। তাই প্রধান নির্মাণ শ্রমিককে নিয়ে আসলাম কয়েকজন সহকারি শ্রমিকের জন্য। দরদাম ঠিক হলে নিয়ে যাবো তাদের। ’

অনেক ক্ষেত্রে মালিকরা শ্রমিকদের কিনতে চলে আসলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধি কিংবা যারা কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ সেই কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কিনে নিয়ে যান।

তবে অনেকে শুধু দিনের জন্য বিক্রি হলেও অনেকে আবার কাজের পারফরম্যান্স দেখাতে পারলে টিকে যান যতোদিন কাজ চলে ততোদিনের জন্য।

সদ্য ‘বিক্রি’ হয়েছেন আজিজ নামের এক শ্রমিক। কাজে যোগ দিতে যাওয়ার সময় অন্য পরিচিত শ্রমিকদের দিকে উদ্দেশ্যে তার চাওয়া, ‘দোয়া করিস, যেন কয়েকদিনের জন্য কাজটা পাই। প্রতিদিন এই টেনশন নিতে ভালো লাগে না। ’

বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৭

টিএইচ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad