ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

প্রতিবাদ করতে গিয়ে ‘লাশঘরে’ ঠাঁই মৌলভী সৈয়দের

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
প্রতিবাদ করতে গিয়ে ‘লাশঘরে’ ঠাঁই মৌলভী সৈয়দের মাওলানা সৈয়দ আহমদ ওরফে মৌলভী সৈয়দ

চট্টগ্রাম: মাওলানা সৈয়দ আহমদ।  মৌলভী সৈয়দ নামে যিনি পরিচিত।  একাত্তরের এই গেরিলা কমান্ডার স্বাধীন দেশে আরও একবার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। পঁচাত্তরে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর।  তবে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দোর্দণ্ড প্রতাপের মুখে বেশিদিন টিকতে পারেননি এই যোদ্ধা।  নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার জীবনপ্রদীপ।

বিপ্লবী জীবনের নির্মম পরিসমাপ্তি ঘটিয়েই সেদিন ক্ষান্ত হয়নি শাসকগোষ্ঠী।  মৌলভী সৈয়দের বাবা একরাম সিকদারকে ঢাকায় সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ছেলের মরদেহ শনাক্ত করতে।

 নিজের চোখের সামনে সন্তানের ছিন্নভিন্ন মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল হতভাগ্য বাবাকে।  মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন মৌলভী সৈয়দের বাবা-মা দুজনই।
 সন্তান হারানোর ব্যথা নিয়ে দুজন ছিলেন আরও কয়েক বছর।  

মৌলভী সৈয়দকে হারানোর ব্যথা জীবনভর বয়ে বেড়াচ্ছেন আরও একজন।  তিনি আলী আশরাফ চৌধুরী।  সৈয়দের বড় ভাই। একাত্তরের সহযোদ্ধা। আগস্ট এলেই ভাই হারানোর ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন আশরাফ।  ৮৫ বছর বয়সী আশরাফ চৌধুরী সেই দিনগুলোর স্মৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বাংলানিউজের কাছে।

বাঁশখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাদ্রাসা থেকে আলেম পাশ করে মৌলভী সৈয়দ শহরে এসে সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।  ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পৌঁছেছিলেন নেতৃত্বের কাতারে।  ১৯৭১ সালের মার্চে ‘জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ গঠিত হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ এবং এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক মেয়র)।   

মৌলভী সৈয়দ একাত্তরে নৌকমান্ডোদের দুঃসাহসিক অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম কমান্ডার ছিলেন।  গেরিলা কমান্ডার হিসেবে রনাঙ্গনে ছিল তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। মহানগরে মৌলভী সৈয়দের সহযোদ্ধা ছিলেন ভাই আশরাফ চৌধুরীও।

আশরাফ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাবা আওয়ামী লীগ করতেন। আমি পল্লী চিকিৎসক ছিলাম। গ্রামে ডাক্তারি করতাম। আমার ভাই শহরে রাজনীতি করত। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা সে মেনে নিতে পারেনি, মেনে নেয়ার কথাও নয়। সৈয়দ বলল, আমরা প্রতিশোধ নেব। সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরীরা মিলে গোপন মিশন শুরু করল। প্রতিবাদের মিশন। ঝটিকা মিছিল করল। চট্টগ্রামে কয়েকটি থানায় আক্রমণও করল।

‘১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের সামরিক অভ্যুত্থান হল। ৭ নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফ নিহত হলেন। পরিস্থিতি পুরোপুরি প্রতিকূলে চলে গেল। চট্টগ্রামে ষড়যন্ত্র মামলা হল। মৌলভী সৈয়দ এক নম্বর আসামি। ধরতে পারলেই মেরে ফেলবে। এরপর ভারতে চলে গেল। ’

পঁচাত্তরের অক্টোবরে সামরিক আইনে গ্রেফতারের প্রায় ছয় মাস পর মুক্তি পেয়ে মহিউদ্দিন ভারতে মৌলভী সৈয়দের সঙ্গে যোগ দেন।  খুনী চক্রকে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ চলছিল।

১৯৭৭ সালের মাঝামাঝিতে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণরত নেতাকর্মীদের অনেককে পুশ ব্যাক করে ভারত। এতে সশস্ত্র প্রতিবাদের পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে।  

মৌলভী সৈয়দের ভাই আশরাফ বাংলানিউজকে বলেন, সৈয়দ প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাবার পর থেকে আমাদের সঙ্গে আর তেমন যোগাযোগ ছিল না। আমি নিজেই তখন আত্মগোপনে ছিলাম। সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িতে কয়েকবার রেইড দিয়েছিল। ভারতে মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় আসার খবর পেয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম।

‘১৯৭৭ সালের ৬ আগস্ট সৈয়দসহ কয়েকজনকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী আটক করে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশ ব্যাক করে। বাংলাদেশের সীমানায় আসার সঙ্গে সঙ্গে আটক করা হয় আমার ভাইকে। তারপর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সেনাবাহিনী তার উপর অত্যাচার করে। ’

আশরাফ বলেন, আমি ছিলাম চকরিয়ায় আত্মগোপনে। বাবার কাছে শুনেছি, আগস্টের ৮ তারিখ বাঁশখালী থানার ওসি আমাদের বাড়িতে আসেন। বাবাকে জিয়াউর রহমান ডেকেছেন বলে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে অবশ্য থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট। ওইদিন রাতেই নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। পরদিন সকালে আমার বাবাকে লাশঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বরফ দিয়ে ১২-১৩ জনের লাশ রাখা হয়েছিল।  

‘বাবাকে বললেন, তোমার ছেলেকে খুঁজে নাও। বাবা একটি, একটি করে লাশ উল্টে দেখলেন।  সৈয়দকে খুঁজে পেলেন। সেনাবাহিনীর একজন মেজর বললেন, আমরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এনেছিলাম। সে (মৌলভী সৈয়দ) রাতে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু বাবা দেখলেন, সৈয়দের শরীর রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত। পোস্টমর্টেমের পর লাশ যেমন হয়, ঠিক তেমনই। ’

এরপর সেনাবাহিনী কঠোর নিরাপত্তায় মৌলভী সৈয়দের মরদেহ হেলিকপ্টারে করে বাবা একরাম সিকদারকে পাঠিয়ে দেয়। হেলিকপ্টার নামে বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়নের মিয়াজী স্কুলের মাঠে। সেখান থেকে গানবোটে করে এক কিলোমিটার দূরে সৈয়দের বাড়িতে নেওয়া হয়।  

‘আমি চকরিয়ায় একটি বাড়িতে ছিলাম। ২-৩ জন গিয়ে আমাকে খবর দেয়, তোমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। আমি সাধারণ মানুষের মতো করে বাড়িতে আসি। তখন লাশ নামানো হচ্ছিল কবরে। চারপাশে সেনবাহিনী টহল দিচ্ছে। আমাকে চিনতে পারেনি। লাশ কবরে নামানোর পর আমি আবার চলে যাই। শুনেছি ১৫ দিন ধরে সেনাবাহিনী কবর পাহাড়া দিয়েছিল। ’

স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন আশরাফ, লাশের ভিড়ে একজন বাবাকে খুঁজতে দেওয়া হয়েছিল তার সন্তানকে। কোন শাসকগোষ্ঠী এমন নির্মম হতে পারে, সেটা ছিল কল্পনারও অতীত। বাবা সহ্য করতে পারেননি। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। ৮৭ সালে মারা যান। আমার মাও সন্তানের শোক সহ্য করতে পারেননি। প্রায় উন্মাদ অবস্থায় ৯০ সালে মারা যান।

‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার বাবা-মা শুধু একটি নামই বলতেন, সৈয়দ। ’ আর বলতে পারলেন না আশরাফ

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৭
আরডিজি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।