যথারীতি অটোরিকশা থেকে নেমে নেসার ও তার সহকর্মী ছুটছিলেন জাহাজ ধরতে। অন্যদিকে অটোরিকশা চালকও ফিরলেন ভিন্ন গন্তব্যে।
বাকিটা শোনা যাক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নেসারের মুখ থেকেই।
‘ব্যাগটিতে ছিল গুরুত্বপূর্ণ সব কাগজপত্র। জাহাজের সঙ্গে চুক্তির ডকুমেন্ট। ছিল বেশ কিছু ডলারও। সবমিলিয়ে ব্যাগটা মহাগুরুত্বপূর্ণ ছিল আমাদের। কিন্তু অটোরিকশা থেকে নেমে প্রায় ১৫মিনিট পর যখন জাহাজের প্রায় কাছাকাছি চলে গিয়েছি তখনিই বুঝতে পারলাম ব্যাগটা নেওয়া হয়নি। তারপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটলাম মাঝিরঘাট এলাকাতেই। ’
নেসার বললেন, ‘সেখানে গিয়ে যখন আশপাশের লোকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। জানতে চাচ্ছিলাম কোনো অটোরিকশাচালক এখানে আসছিল কিনা। এমন সময় সেখানকার একজন শ্রমিক এসে বললেন, ‘‘ভাই একজন অটোরিকশাচালক এসে আপনাকে খুঁজেছেন। তার গাড়িতে আপনার একটা ব্যাগ ফেলে গেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি আপনাকে না পেয়ে আমাদের কাছে তার মোবাইল নম্বর দিয়ে গেছেন। ’
‘অটোরিকশাচালকের নম্বর পেয়ে আমি তো মহাখুশী। দ্রুত ফোন দিলাম তাকে। পরিচয় দিতেই তিনি খুব আনন্দের সঙ্গেই জানালেন ভাই ‘‘এই ব্যাগে কি আছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু ব্যাগটি ফিরিয়ে দেব কিভাবে তার চিন্তায় ছিলাম। আমি প্রি-পোর্ট এলাকায় একটা ভাড়া নিয়ে এসেছি। আপনি দয়া করে বারিক বিল্ডিং এলাকায় অপেক্ষা করেন। আমি এক ঘণ্টার মধ্যেই আসছি। ’’ আমি যথারীতি সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করলাম। তিনি এক ঘণ্টার আগেই ঘটনাস্থলে এসে ব্যাগটা আমার হাতে তুলে দেন। ’-বলেন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নেসার।
নেসারের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন অটোরিকশাচালককে ফোন দেওয়া হলে তিনি প্রথমেই এ বিষয়ে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। নাম জানতে চাইলে বললেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
এরপর অনুরোধের সুরে জানতে চাইলে বলেন, ‘প্রচারের জন্য আমি কাজটি করিনি। এটা আমার দায়িত্ব ছিল। ওনাদের নামিয়ে দিয়ে যখন অনেকদূর চলে আসলাম তখনই ব্যাগটা যে আমার গাড়িতে রয়ে গেছে সেটা জানতে পারলাম। এরপর থেকে আমি খুব টেনশনে ছিলাম কিভাবে তাদের ব্যাগটা তুলে দেই। পরে তাদের যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলাম সেই মাঝিরঘাটে গিয়ে তাদের খুঁজতে থাকি। কিন্তু তাদের না পেলে ওই এলাকার কয়েকজন শ্রমিকের কাছে আমার নম্বরটা দিয়ে আসি। যাতে ওনারা সেখানে এসে খোঁজ নিলে যেন নম্বর পেয়ে আমাকে ফোন দিতে পারেন। পরে তাদের একজন ফোন দিলে আমি গিয়ে ব্যাগটা দিয়ে আসি। ’
‘ব্যাগটা আমি ধরেও দেখিনি। কারণ এটা আমার কাছে আমানতের মতো ছিল। মালিকের কাছে ব্যাগটা তুলে দিতে পেরে নিজেকে এখন খুব হালকা লাগছে। ’-হাসি নিয়ে বললেন ইব্রাহিম।
অটোরিকশাচালক ইব্রাহিম জানান, তার বাড়ি ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলায়। চট্টগ্রাম শহরে বাস করেন ১৫ বছর ধরে। তবে অটোরিকশা চালাচ্ছেন প্রায় এক যুগ ধরে। তার তিনটি ছেলে আছে। স্ত্রী-ছেলেরা থাকেন গ্রামের বাড়িতেই। তিনি হালিশহর বি-ব্লকে অন্য সহকর্মীদের নিয়ে থাকেন।
কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এর আগেও একজন তার গাড়িতে অনেক দামি একটা মোবাইল ফেলে গিয়েছিলেন। আবার আরেকজন ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা তার চাকরি জীবনের শুরুর দিন বিভিন্ন ওষুধের স্যাম্পলে ভরা ব্যাগ ফেলে গিয়েছিলেন। দুজনকেই তাদের জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তারা খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার জন্য অনেক দোয়া করেছিলেন। ’
তরুণ সাইফুল ইসলাম নেসার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করেন একটি জাহাজে। চাকরির অবসরে সময় কাটান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অজ্ঞাতনামা, অসহায় রোগীদের সেবা করে। গত দশ বছরে ২০০ এর উপর মানুষ বাড়িতে ফিরতে পেরেছেন তার সহযোগিতায়।
ব্যাগটা ফিরে পেয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম নেসার।
বলতে থাকেন, ‘ব্যাগটি হারিয়ে আমার শরীর প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মহৎ একজন মানুষের কল্যাণে ব্যাগটি ফিরে পেলাম। এই ঋণ কখনও শোধ করা যাবে না। এমন ভালো মানুষ আছে বলেই পৃথিবীটা এখনও এতো সুন্দর। ’
বছর ৪০ ছুঁইছুঁই অটোরিকশাচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম নিতান্তই গরিব মানুষ। কিন্তু দেখিয়ে দিলেন অন্তরের দিক দিয়ে কতো বড় ধনী তিনি ! তাই এই মানুষটাই যেন আজ থেকে হয়ে থাকল এই শহরের সততার ‘পোস্টার বয়’ !
বাংলাদেশ সময়: ২২১২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৭
টিএইচ/টিসি