এ গল্প ভ্রাম্যমাণ ‘রেখা সরিষার তৈল’ কারখানার উদ্যোক্তা রেখা আলম চৌধুরীর। যে কারখানায় ক্রেতার সামনেই সরিষা থেকে তেল তৈরি করা হয়।
রেখা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র, চিটাগাং উইম্যান চেম্বারের সাবেক পরিচালক, এফবিসিসিআইর সাবেক সদস্য।
অদম্য ইচ্ছেশক্তির কারণেই বিয়ের পরও লেখাপড়া বন্ধ করেননি নারায়ণগঞ্জের রেখা। লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে সম্মানসহ মাস্টার্স। করেছেন এমফিলও। মেয়েকে ডাক্তার বানিয়েছেন। ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন বিদেশে। বাকি দুই ছেলে উচ্চমাধ্যমিক ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে।
বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারে বিয়ে হয়েছিল রেখার। স্বামীর শিপিং বিজনেস। অভাব-অনটনের বালাই নেই। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত রেখা স্বপ্ন বুনছিলেন নিজে কিছু করার। বাঁধাধরা সরকারি চাকরিতে মন সাঁয় দিল না। কিন্তু তাগিদ ছিল কিছু করতেই হবে। অবশেষে চবিতে অধ্যয়নকালে পদ-পদবি ছাড়া যে ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে সক্রিয় ছিলেন তা-ই ঘুরপাক খেতে লাগল মনে। ঢাকার এক খালার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। প্রার্থী হবেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে।
স্বামীকে যখন এ ইচ্ছের কথা জানালেন ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ‘তোমাকে কে চেনে? ভোট দেবে কেন?’ অনুযোগ থাকলেও নিষেধ করেননি। খরচও দিলেন। প্রথমবারেই নির্বাচিত হলেন। কিন্তু নগর ভবনে গিয়ে দেখলেন নানা বৈষম্য। তিন ওয়ার্ড থেকে অনেক বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়েও পুরুষ কাউন্সিলরের তুলনায় কাজ করার সুযোগ নেই বললেই চলে।
রেখা বললেন, ‘জাতীয়তা সনদ দিতে পারি না। সাইনিং অথরিটি নেই। মনটাই খারাপ হলো। একপর্যায়ে নারী কাউন্সিলরা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনও করি। ২০০৭ সালে প্যানেল মেয়র করা হলো। পরের বারও পদ পেলাম। সাধ্যমতো মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি। অবহেলিত নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, বয়স্ক বিদ্যালয় চালু করলাম। কিন্তু থোক বরাদ্দ এনে আর কত উপকার করা যায়! সমাজসেবার জন্য প্রচুর টাকার দরকার। অবশেষে সৎভাবে উপার্জনের জন্য ব্যবসা করার চিন্তাটা পেয়ে বসে। এমন ব্যবসা চেয়েছিলাম যাতে মানুষের আস্থা থাকবে এবং আমাকে ভালোবাসবে। ’
টিনের কৌটা তৈরি, এলইডি লাইট ও সোলার প্যানেল বাজারজাত, তেল বোতলজাত করা, ইলেকট্রনিকস পণ্যের শোরুম অনেক ব্যবসাই করছেন রেখা। তবে সবচেয়ে প্রিয় ব্যবসাটা ‘রেখা সরিষার তৈল’ কারখানা। যেটির সঙ্গে নিজের নামটিই জুড়ে দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সয়াবিন তেলের সঙ্গে পাম অয়েল মেশানোর কথা শুনেছি। বাজারে সরিষার তেলেও ঝাঁজ বাড়ানোর জন্য নানান গোঁজামিলের বিষয় দেখেছি। কিন্তু ঘরে ঘরে আচার-চাটনি, মুড়িমাখানো, ভর্তার মতো মুখরোচক খাবার ও শিশুদের জন্য সরিষার তেলের ব্যবহারটা বেশি। আকস্মিকভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চট্টগ্রামে একটি ঘানি বসাবো। টাঙ্গাইল ছুটে গেলাম। তখনই ভাবলাম ঘানির জন্য বড় জায়গা দরকার। গাড়ির ওপর একটি মেশিন বসিয়ে ভ্রাম্যমাণ কারখানা বানাব। ক্রেতাদের সামনেই সরিষা থেকে তেল বানিয়ে দেব।
দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গি ও ভেজালমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সচেষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভেজালমুক্ত দেশ গড়ার লড়াইতে শামিল হলাম আমি। ’
রেখা মনে করেন, বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে আমাদের তরুণরা নতুন নতুন অনেক কিছুই করতে পারে।
‘ভ্রাম্যমাণ সরিষার তেল কারখানা দিয়ে অন্তত কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করতে পেরেছি, কিছু মানুষকে ভেজালমুক্ত তেল দিতে পারছি এটিই বড় পাওয়া। ’ তৃপ্ত কণ্ঠে বললেন রেখা।
ক্রেতার সামনেই সরিষার তেল তৈরি রেখার
বাংলাদেশ সময়: ১০৩১ ঘণ্টা, ২৭ মে, ২০১৭
এআর/টিসি