ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কর্ণফুলীর ‘অভিশাপে’ অপ্রতিরোধ্য জলাবদ্ধতা

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৭
কর্ণফুলীর ‘অভিশাপে’ অপ্রতিরোধ্য জলাবদ্ধতা কর্ণফুলীর ‘অভিশাপে’ অপ্রতিরোধ্য জলাবদ্ধতা (ছবি: উজ্জল ধর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম)

চট্টগ্রাম: সকাল সাড়ে ৯টা।  নগরীর চামড়ার গুদাম দিয়ে আছাদগঞ্জের শুঁটকিপট্টির প্রবেশপথে শুঁটকির দোকানদার আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল জলাবদ্ধতা নিয়ে।  জানালেন, গেল বৃষ্টিতে তার দোকানের ভেতরেই এক হাঁটু পানি হয়েছিল।  বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে কয়েক লাখ টাকার শুঁটকি। 

আজাদ বলেন, ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছি।   কোনদিন আমাদের দোকানে পানি উঠেনাই।

  এখন যে অবস্থা বর্ষাকালে মনে হচ্ছে দোকানের ভেতর ৭-৮ ফুট পানি উঠবে।

জলাবদ্ধতার এই চিত্র জানাতে গিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এই ব্যবসায়ী, ‘কর্ণফুলী নদীটাকে মেরে ফেলেছে।

  কারা মেরেছে ? আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা মারিনি।   যারা জলাবদ্ধতা নিয়ে বড় বড় কথা বলছে তারা মেরেছে।   কর্ণফুলী নদীটাকে মেরে নিজেরাই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে।   আবার তারাই বড় বড় ভাষণ দেয়। ’

আজাদের এই আক্ষেপের সঙ্গে একাত্মতা জানান প্রতিবেশি দোকানদাররাও।  

স্থানীয়দের মতে, মিয়াখান নগর থেকে ফুলতলা সড়ক হয়ে আনুমানিক পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে চামড়ার গুদাম।   এক দশক আগেও কর্ণফুলী নদীর মোহনা ছিল চামড়ার গুদাম এলাকায়।   সেই মোহনার উপর এখন গড়ে উঠেছে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।   ফলে এখন মোহনা চলে গেছে এর থেকে আরও এক কিলোমিটার দূরে।   সেখানেও পলিমাটির চর জেগে উঠছে।   সংকুচিত হয়ে পড়েছে মোহনা।   ফলে জোয়ার-ভাটার পানি এখন আর স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হয় না।   খালের পানি নদীতে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।   নগরের দক্ষিণ-পূর্ব অংশজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।

কর্ণফুলীতে ৪৫ বছর ধরে পণ্যবোঝাই নৌকা চালাচ্ছেন মো.হাকিম মাঝি।   তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আগে তো নৌকা নিয়ে চকবাজার পর্যন্ত চলে যেতাম।   এখন চামড়ার গুদামও পার হতে পারি না।   চাক্তাই খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের সময় পানি উঁচুতে উঠে যায়।   ভাটার সময় পানি থাকে না।

নৌকা থেকে পণ্য খালাস করে জীবিকা নির্বাহ করা কামাল উদ্দিন কর্ণফুলীর মোহনা দেখিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, এখন মোহনা থেকে ৫০ হাত পর্যন্ত নদীতে হেঁটে যাওয়া যায়।   পানি এক কোমড়ের বেশি হয় না।   নদীটা শেষ হয়ে গেছে, পুরাই শেষ।

পিলারযুক্ত তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে নদী ভরাট এবং নতুন ফিশারিঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনার কারণে কর্ণফুলী নদীর মোহনা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর জামাল হোসেন।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, কর্ণফুলী নদী খননের সময় আমরা ভেবেছিলাম চর খনন করে নদী প্রশস্ত করা হবে।   কিন্তু চরের উপর পাকা স্থাপনা বানিয়ে নদীটাকে স্থায়ীভাবে ছোট করে ফেলা করা হয়েছে।   পিলার সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করেছিলেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।   সেই বিরোধিতা আমলে না নিয়ে পিলার সেতু করেছে।   এখন পলি জমে মোহনা ভরাট হয়ে যাচ্ছে।  

দিনমজুর কামাল উদ্দিন নতুন ফিশারিঘাট দেখিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, এই ফিশারিঘাটটা পুরোটাই নদীর উপর করা হয়েছে।   আগে মেরিনার্স রোড পর্যন্ত নদী ছিল।  

সাবেক কাউন্সিলর জামাল হোসেনসহ স্থানীয়রা জানান, চামড়ার গুদাম থেকে আশপাশের এলাকায় শতাধিক ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে।   চরের জমিতে চার-পাঁচটা বস্তি বানানো হয়েছে।   সব মিলিয়ে কর্ণফুলী নদীর অবস্থা এখন মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়েছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, কর্ণফুলী নদীর তীরে মোট ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমি দখল করে অবৈধভাবে স্থাপনা গড়ে উঠেছে।  দখল করা জমিতে কাঁচা ঘর, দোকান, ভবন, বালুর স্তুপ, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, মৎস্য প্রকল্প, জসিম উদ্দিন প্রাথমিক বিদ্যালয়, সৎসঙ্গ বিহার, দাতব্য চিকিৎসালয়, প্ল্যাস্টিক, বোতল ও গার্মেন্টস কারখানা এবং মুরগির খামার গড়ে তোলা হয়েছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের মতে, কর্ণফুলীর মোহনা ভরাটের কারণে নগরীতে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করার তথ্য পুরোপুরি সঠিক নয়।   সমস্যা হচ্ছে, যে গতিতে খাল-নালা দিয়ে নগরীতে পানি প্রবেশ করে সেই একই গতিতে বেরুতে পারে না।   খাল-নালাগুলো ভরাট হয়ে যাবার কারণে সমস্যা হচ্ছে।

তবে এই সমস্যা এককভাবে সিটি করপোরেশন সমাধান করতে পারবে বলেও মনে করেন না দেলোয়ার মজুমদার।   তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সিটি করপোরেশনের মেয়রকে এককভাবে কোন সমন্বয়ের এখতিয়ার দেয়া হয়নি।   অথচ এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে সকল সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৭

আরডিজি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।