ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

যে আদেশ দিতে গিয়ে ব্যথিত বিচারকও

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭
যে আদেশ দিতে গিয়ে ব্যথিত বিচারকও লোগো

চট্টগ্রাম: ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতক ছেলে ‘একুশকে’ জিম্মায় দেয়ার আদেশ দিতে গিয়ে ব্যথিত হয়েছেন বিচারক।  আদেশ দেয়ার সময় চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ও শিশু আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদৌস নিজেই বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। 

লিখিত চার পৃষ্ঠার আদেশের তৃতীয় পৃষ্ঠায় বিচারক উল্লেখ করেন, শুনানিকালে নি:সন্তান ‍আবেদনকারীদের আকুতি মানুষ হিসেবে আমাকে ব্যথিত করেছে।   আমি খুব অসহায় বোধ করেছি আমার সাধ্যের সীমাবদ্ধতার জন্য।

 

‘আমার হেফাজতে এরূপ একাধিক শিশু থাকলে আমি নি:সন্তান প্রত্যেক দম্পতিকে একটি করে শিশু জিম্মায় দিতাম।   তাহলে আমাকে আবেদন বাছাইয়ের আগে মা-বাবার অসহায়ত্বের কান্নার গভীরতা যাচাই করতে হতো না।

  যেহেতু ১২ জন আবেদনকারীর মধ্যে ১১ জনই নি:সন্তান, সেহেতু আমাকে বাধ্য হয়েই এসব নি:সন্তান দম্পতিদের হাহাকারের মাঝেও ত্রুটি খুঁজতে হয়েছে। ’ আদেশে উল্লেখ করেন বিচারক

বিচারক আদেশের এই অংশটুকু পড়ে শোনানোর সময় এজলাস কক্ষ জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে।   আদালতে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।   একুশকে পেতে যেসব নারী আবেদন করেছিলেন তাদের চোখ দিয়ে টপটপ করে পড়তে থাকে পানি।    

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলি ও অতিরিক্ত মহানগর পিপি অ্যাডভোকেট এম এ ফয়েজ বাংলানিউজকে বলেন, আদেশ ঘোষণার সময় বিচারক পুরো বিষয়টি উপস্থাপন করেননি।   আদেশের সারসংক্ষেপ পড়েছেন।   পরবর্তীতে পুরো আদেশ প্রকাশ করা হয়েছে।

১২ জন নারীর আবেদন যাচাইবাছাই করে বুধবার (২৯ মার্চ) একুশকে বিয়ের ১৯ বছর পরও নি:সন্তান থাকা ডাক্তারপত্নী শাকিলা আক্তারের জিম্মায় দিয়েছেন বিচারক।   আদেশ দেয়ার সময় ৯ জন আবেদনকারী আদালতে উপস্থিত ছিলেন।   এদের মধ্যে ৮ জনই নি:সন্তান।

আবেদন যাচাইবাছাইয়ের ক্ষেত্রে আবেদনকারীদের দাবি, দাখিল করা কাগজ, দম্পতির পেশা ও বিবাহিত সময়কালকে মানদণ্ড ধরা হয়েছে বলে বিচারক আদেশে উল্লেখ করেছেন।   পুরো বিষয়টিতে বিচারক শিশুটির সার্বিক মঙ্গলকেই গুরুত্ব দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন।  

তৃতীয় পৃষ্ঠায় বিচারক উল্লেখ করেন, শুনানিকালে প্রত্যেক আবেদনকারীই তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার গ্যারান্টিসহ শিশুটিকে নানা মূল্যবান সম্পদ দানের অঙ্গীকার করেছেন।   বলাবাহুল্য আবেদনকারী সকলেই স্বচ্ছল।   তবে এক্ষেত্রে এই নবজাতকের ‍নামে মূল্যবান সম্পদ নেয়া আদালত হিসেবে আমি সমীচীন ও সঙ্গত মনে করছি না।  

‘এই সম্পদের লোভে ভবিষ্যতে যে কেউ তার মা-বাবা সেজে তাকে সন্তান দাবি করে তার জীবন আরো দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।   এক্ষেত্রে শিশুটির সামগ্রিক কল্যাণই মূল বিবেচ্য বিষয়। ’ আদেশে উল্লেখ করেন বিচারক

বিচারক উল্লেখ করেন, আবেদনকারী ১২ নারীর মধ্যে ৯ জন গৃহিণী, একজন শিক্ষিকা, একজন আইনজীবী ও একজন পুলিশ।   তাদের স্বামীদের পাঁচজন ব্যবসায়ী, চারজন চাকুরিজীবী, একজন চিকিৎসক ও একজন আইনজীবী।

লিখিত আদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ১২ আবেদনকারীর ১১ জনের আবেদন নামঞ্জুর হওয়ার বিষয়ে ব্যাখা দেন বিচারক।  

আবেদনকারীদের মধ্যে জেসমিন আক্তার, লুবনা ইয়াসমিন, শাহিদা জাহান, ইয়াসমিন আক্তার, শবনম শারমিন, ইসরাত জাহান ও গোলসান আক্তার আবেদনে উল্লেখ্য করেছে তারা কখনও মা হতে পারবেন না।   কিন্তু চিকিৎসা সনদ দাখিল করেননি।  

আবেদনকারী অ্যাডভোকেট চুমকি চৌধুরী এক কন্যা সন্তানের মা।  তার ছেলের আকুতি রক্ষা করতে পারেননি বিচারক।

শাহানারা আক্তার নামে একজন আবেদনকারী চিকিৎসা কর্মকর্তার সনদ জমা দিলেও ওই চিকিৎসক গাইনি বিষয়ের ডাক্তার নন।

পারভিন আক্তার নামে একজন আবেদনকারী ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনের চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার কাগজ জমা দিয়ে আদালতের কাছে দাবি করেছেন, তার মা হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ নেই।   আদালত বাকি ১০ শতাংশ সম্ভাবনাকে ধর্তব্য হিসেবে নিয়েছেন।

জান্নাতুল ফেরদৌস নামে একজন আবেদনকারী আবেদনে বলেন, ২০১২ সালে বিয়ে হওয়ার পর তিনি তিন সন্তান প্রসব করেন।   প্রত্যেক সন্তানই মারা গেছেন।   পরবর্তী সন্তান নেওয়া তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।   আদালত আদেশে বলেছেন, ‘মাতৃত্ব’ সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ।

শাকিলা আক্তারের জিম্মায় একুশকে দেয়ার বিষয়ে লিখিত আদেশের শেষ পৃষ্ঠায় বিচারক উল্লেখ করেছেন, তিনি পেশায় একজন গৃহিণী।   তার স্বামী পেশায় একজন ডাক্তার।   অত্র নবজাতক পিতৃমাতৃহীন।   চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে শিশুটি।   তার সার্বিক কল্যাণ বিবেচনায় আমি তাকে আবেদনকারী শাকিলা আক্তারের জিম্মায় প্রদান অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করছি।

তবে শাকিলার জন্য চার দফা শর্ত উল্লেখ করে আদেশের উপসংহার টেনেছেন বিচারক।   এগুলো হল, শিশুটির নামে দশ লাখ টাকার শিক্ষাবীমা করে ৫ এপ্রিলের মধ্যে আদালতে কাগজ দাখিল করে প্রকাশ্য আদালত থেকে জিম্মায় নিতে হবে।

শিশুটির প্রকৃত মা-বাবার সন্ধান পাওয়া গেলে এবং তার নিতে আগ্রহী হলে ডিএনএ টেস্ট করিয়ে তাদের ফেরত দিতে হবে।

প্রথম বছর প্রতি তিনমাস অন্তর, দ্বিতীয় বছর প্রতি ছয় মাস অন্তর এবং ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে শিশু আদালতে এসে শিশুটির সার্বিক অবস্থা উপস্থাপন করতে হবে।

শিশুটির স্বার্থের পরিপন্থী কোন কাজ করলে জিম্মা বাতিল হবে।  

বিচারক আদেশের কপি আবেদনকারী শাকিলা আক্তার, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এবং নগরীর আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) রাত ১২টার দিকে নগরীর কর্ণেলহাট এলাকার লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার সংলগ্ন ড্রেন থেকে নবজাতকটিক উদ্ধার করে পুলিশ।   শিশুটি বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছে।

একুশের রাতে উদ্ধার হওয়ায় আকবর শাহ থানার ওসি আলমগীর মাহমুদ এর নাম রাখেন ‘একুশে’।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৭

আরডিজি/টিসি

‘একুশকে’ পেলেন শাকিলা

**‘একুশ’ যাবে কার জিম্মায়, আদেশ আসবে বুধবার

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।